এআই-নির্ভর অটোমেশন, ধীরগতির বৈশ্বিক অর্থনীতি ও ব্যয় সঙ্কোচনের জেরে ২০২৫ সালে বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ ছাঁটাই-সুনামি। মাত্র ১১ মাসে কাজ হারিয়েছেন ১১.৭ লাখের বেশি মানুষ।
ওয়াশিংটন : ২০২৫ সালের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যেন নতুন এক অস্থিরতার ঘূর্ণিতে আটকে গেছে। অর্থনীতিবিদরা যার নাম দিয়েছেন—‘রিসট্রাকচারিং রিসেশন’। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত অটোমেশন, অতিরিক্ত কর্মী বোঝা, ধীরগতির প্রবৃদ্ধি এবং অনিশ্চিত বাজারে ব্যয় সঙ্কোচনের জেরে বিশ্বজুড়ে যে ভয়াবহ ছাঁটাই চলছে, তা মহামারির পর নজিরবিহীন।
জানুয়ারি থেকে নভেম্বর—এই ১১ মাসে বিশ্বব্যাপী ৪,২০০-রও বেশি বড় ছাঁটাইয়ের ঘটনায় কাজ হারিয়েছেন প্রায় ১১.৭ লাখ মানুষ। কোভিডের সময় ২০২০ সালে প্রায় ২২ লাখ মানুষ বেকার হয়েছিলেন; তার পর এত বড় মাপের চাকরি-হানি আর হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, এআই-নির্ভর অটোমেশনই এই সংকটের কেন্দ্রবিন্দু। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশে বহু ক্ষেত্রেই ওয়ার্কফ্লো বদলে যাচ্ছে। কোডিং অ্যাসিস্ট্যান্ট শক্তিশালী হওয়ায় ডেভেলপার কমানো হচ্ছে, জেনারেটিভ এআই দখল করে নিচ্ছে কনটেন্ট তৈরির কাজ। গ্রাহক পরিষেবা থেকে ডেটা অ্যানালাইসিস—অসংখ্য বিভাগেই মানুষের জায়গা নিচ্ছে মেশিন। ফলে সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে প্রযুক্তি শিল্পে। শুধু ২০২৫ সালেই বিশ্বজুড়ে অন্তত ৬৮৩টি টেক সংস্থা বড়সড় ছাঁটাই করেছে, চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ২ লাখ কর্মী। গড়ে প্রতিদিন ৬০০-রও বেশি টেক কর্মী চাকরি হারিয়েছেন।
টেকের পাশাপাশি রিটেল ও গুদামজাতকরণ ক্ষেত্রেও বিপর্যয় নেমে এসেছে। ভোক্তা ব্যয় কমে যাওয়া এবং ই-কমার্সের অনিশ্চিত বাজারে পশ্চিমা দেশগুলিতে ছাঁটাই দ্রুত বেড়েছে। বিশেষ করে আমেরিকায় খুচরো বাণিজ্যে ছাঁটাই বেড়েছে ১৪৫ শতাংশ। আইএলও জানাচ্ছে, উন্নত অর্থনীতিগুলিতে বেকারত্ব বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ।
সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। অক্টোবর পর্যন্ত দেশটিতে চাকরি হারিয়েছেন ১০.৯৯ লাখ মানুষ—২০২৪ সালের তুলনায় যা প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি। শুধুমাত্র নভেম্বরে নতুন করে ছাঁটাই হয়েছে ৭১,০০০। আশ্চর্যের বিষয়, সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে সরকারি খাতে। সরকারি বিভাগে চাকরি হারিয়েছেন ৩,০৭,৬৩৮ জন—মার্কিন ইতিহাসে যা সর্ববৃহৎ গণছাঁটাই। সরকারের ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি ইনিশিয়েটিভ’-এর অধীনেই এই কাটছাঁট করা হয়েছে।
প্রযুক্তি ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি হারিয়েছেন ১,৪১,১৫৯ জন, যার মধ্যে শুধুমাত্র অক্টোবরেই বাদ পড়েছে ৩৩,০০০ পদ। গুগল, মাইক্রোসফট, ইন্টেলসহ শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলি এআই প্রয়োগের মাধ্যমে আরও ‘লীন ও স্মার্ট’ টিম গড়তে ব্যাপক ছাঁটাই করেছে। রিটেলে ছাঁটাই ৮৮,৬৬৪ এবং আর্থিক খাতে ৪৮,৯৬৮—যেখানে উচ্চ সুদের হার এবং মন্থর ডিল-ফ্লো প্রধান কারণ।
ভারতেও ছাঁটাই চলছে নীরবে। আইটি খাতে প্রকল্প কমে যাওয়া, বিদেশি ক্লায়েন্টের চাহিদা হ্রাস এবং স্টার্টআপ সেক্টরে আর্থিক সংকটের কারণে বহু সংস্থায় কর্মীদের ‘স্বেচ্ছায় বিদায়’ নিতে বাধ্য করা হয়েছে। অতিরিক্ত সম্প্রসারণ ও তহবিল সংগ্রহের সমস্যায় স্টার্টআপ জগতে ব্যাপক চাকরি হানি ঘটেছে।
বিশ্ব যখন ২০২৬-এর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছে, তখন প্রশ্ন উঠছে—এআই কি মানুষের চাকরি কেড়ে নেবে, নাকি নতুন দক্ষতা ও নতুন কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করবে? উত্তর এখনও স্পষ্ট নয়। তবে সত্য এটাই, বিশ্ব শ্রমবাজার আজ ইতিহাসের অন্যতম কঠিন সময়ের সাক্ষী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন