মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ক্ষমতায় আসার আগে মানুষকে আমরা যা বলেছিলাম, তার কতটা পূরণ করেছি তা জানানোর দায়িত্ব আমাদের।”
কলকাতা : '২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হতেই রাজ্যে রাজনীতির পারদ চড়ে গিয়েছে। ভোটের ঠিক আগে উন্নয়নের খতিয়ান তুলে ধরে মঙ্গলবার ‘পঞ্চদশ বর্ষের রিপোর্ট কার্ড’ প্রকাশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর গত ১৫ বছরে রাজ্যের বিভিন্ন দফতর—স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, কর্মসংস্থান, পরিকাঠামো ও সামাজিক সুরক্ষা—কীভাবে বদলে গিয়েছে, সেই পূর্ণাঙ্গ তথ্য-পরিসংখ্যান তিনি সামনে আনলেন। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “আগেকার দিনে সন্ধেয় গ্রামে পাঁচালি পড়া হত। সেই গৌরব ধরে রাখতে উন্নয়নের পাঁচালি আজ বাংলার মানুষকে শোনালাম। মানুষের কাছে আমাদের দায়বদ্ধতা জানাতেই এই রিপোর্ট কার্ড।”
জনগণের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। ফাইল ছবি।
মুখ্যমন্ত্রীর রিপোর্ট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই আক্রমণের সুর চড়াল বিরোধী শিবির। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তীব্র ভাষায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করে বলেন, প্রয়াত রতন টাটার মন্তব্যই মুখ্যমন্ত্রীর শিল্পনীতির আসল সার্টিফিকেট। “ট্রিগার মাথায় রেখে আমাকে রাজ্য থেকে তাড়ানো হল, সেই সময় আমি খারাপ M থেকে ভাল M—গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে গিয়েছিলাম। আর আপনি তখন ছিলেন বিরোধী দলনেত্রী। শিল্পে আপনার সার্টিফিকেট প্রয়াত রতন টাটা দিয়ে গিয়েছেন,” কটাক্ষ শুভেন্দুর। তিনি আরও দাবি করেন, দেউচা পাঁচামিতে ১ লক্ষ কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি থেকে শুরু করে ৪২ লক্ষ যুব-যুবতীকে স্কিল ট্রেনিংয়ের কথা—সবই “নির্বাচনী চাল”। সঙ্গে তাঁর চ্যালেঞ্জ, “এর তালিকা প্রকাশ করুন।” স্বাস্থ্য বাজেটে ছয় গুণ বৃদ্ধির দাবি তুলে শুভেন্দুর আহ্বান, রাজ্যে অবিলম্বে আয়ুষ্মান ভারত চালু করা হোক।
বিজেপি নেতা আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতার পাঁচালি পড়েছেন। এটা আসলে জলাঞ্জলির পাঁচালি—বাংলার গৌরব, সংস্কৃতি, মেয়েদের সম্মান, কন্যাদের সুরক্ষা—সবই আপনার আমলে বিপন্ন।” তিনি জানান, জানুয়ারি থেকে বিজেপি ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করবে। ২০১১, ২০১৬, ২০২১-এর বাজেটসহ বিভিন্ন দফতরের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের তুলনামূলক হিসেব জনসমক্ষে তুলে ধরবেন তাঁরা।
অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী নিজের রিপোর্ট তুলে ধরে বলেন, “ক্ষমতায় আসার আগে মানুষকে আমরা যা বলেছিলাম, তার কতটা পূরণ করেছি তা জানানোর দায়িত্ব আমাদের।” সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে মোট ৯৪টি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প কার্যকর হয়েছে—কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কৃষকবন্ধু, ছাত্রছাত্রীদের ক্রেডিট কার্ড—সব মিলিয়ে এই প্রকল্পগুলি উপকৃত করেছে কোটি কোটি মানুষকে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সুবিধা পেয়েছেন ২ কোটি ২১ লক্ষ মহিলা, তাতে খরচ হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। দারিদ্রসীমার উপরে তোলা হয়েছে ১ কোটি ৭২ লক্ষ মানুষকে। কর্মসংস্থানে ৪০ লক্ষ বেকারত্ব হ্রাসের দাবি জানানো হয়েছে। স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় সুবিধাপ্রাপ্ত ২ কোটি ৪৫ লক্ষ পরিবার। দুয়ারে রেশনের সুবিধা পেয়েছে ৭ কোটি ৪১ লক্ষ মানুষ। শুধু অর্থনৈতিক করিডরেই কর্মসংস্থান ১ লক্ষেরও বেশি। বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালিতে ২ হাজার সংস্থায় কাজ পেয়েছেন প্রায় ২ লক্ষ মানুষ। আসানসোল–দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে এসেছে ২২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ।
এছাড়া ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প খাতে ১ লক্ষ ৩০ হাজার প্রকল্প, কন্যাশ্রীর সুবিধাভোগী ১ কোটিরও বেশি, রূপশ্রীতে খরচ ৫৫৯৮ কোটি, পরিকাঠামো উন্নয়নে খরচ ৭০ হাজার কোটি, ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা ১ লক্ষ ঘর—এমনই পরিসংখ্যান তুলে ধরেন মমতা। গঙ্গাসাগর সেতুর ব্যয় ১,৭০০ কোটি টাকা, পথশ্রী প্রকল্পে ৭ হাজার কিলোমিটার রাস্তার লক্ষ্য—যার মধ্যে ৫ হাজার ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণ। পর্যটনেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি—২০২৫ সালের অক্টোবরেই বাংলায় এসেছেন ২৪ কোটি দেশি-বিদেশি পর্যটক, যা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাধিক।
কেন্দ্রীয় বঞ্চনার প্রসঙ্গও এদিন ফের তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অভিযোগ, জিএসটি বাবদ কেন্দ্র রাজ্যের প্রাপ্য টাকা আটকে রেখেছে প্রায় ২ লক্ষ কোটি। “তবু নিজেদের উদ্যোগে কর্মশ্রী, বাংলার বাড়ির মতো প্রকল্প চালু রেখেছি। বাংলা আজ দেশের উন্নয়নের মডেল,” মন্তব্য মুখ্যমন্ত্রীর।
ভোটের এক বছর আগে সরকারের উন্নয়নের পাঁচালি এবং বিরোধীর পাল্টা জলাঞ্জলির পাঁচালি—দুইয়ের টানাপোড়েনে রাজ্যের রাজনৈতিক আবহও যে আরও গরম হতে চলেছে, তা স্পষ্ট।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন