এআই-নির্ভর রাজনৈতিক প্রভাব: গণতন্ত্রের সামনে নতুন বিপদ

নতুন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এআই চ্যাটবট রাজনৈতিক মতামত পরিবর্তনে অত্যন্ত প্রভাবশালী। সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে যখন তারা ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ব্যবহার করে। লিখছেন পাণ্ডব সরকার

এআই-নির্ভর রাজনৈতি প্রভাব: গণতন্ত্রের সামনে নতুন বিপদ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জীবনকে যত দ্রুত পাল্টে দিচ্ছে। তার প্রভাব রাজনীতি ও গণতন্ত্রের উপর কতটা গভীর হতে পারে, সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা তারই কঠোর ইঙ্গিত দিল। ‘সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাটি জানাচ্ছে, রাজনৈতিক মতামত বদলে দিতে এআই চ্যাটবট এখন ভয়ঙ্কর দক্ষ—আর সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, তারা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় তখনই, যখন তারা ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ব্যবহার করে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ ব্রিটেন ও আমেরিকার বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা প্রায় ৭৭ হাজার মানুষের উপর পরীক্ষায় দেখেছেন, ওপেনএআই, মেটা ও xAI-র মডেলসহ বিভিন্ন চ্যাটবট ব্যবহারকারীদের রাজনৈতিক মত বদলে দিতে বারবার সফল হয়েছে। অংশগ্রহণকারীরা যেই মতাদর্শেরই হোন না কেন—উদার বা রক্ষণশীল—চ্যাটবটের যুক্তির চাপে তারা বিপরীত অবস্থানের দিকে ঝুঁকেছেন। সবচেয়ে কার্যকর কৌশল ছিল বিপুল পরিমাণ বিশদ তথ্য একবারে হাজির করা। যে কৌশলে নৈতিক আবেদন বা ব্যক্তিগতভাবে সাজানো যুক্তির তুলনায় অনেক বেশি প্রভাব পড়েছে। গবেষণার ভাষায়, এআই চ্যাটবটের ক্ষমতা এমন যে তারা ‘অভূতপূর্ব গতিতে বিপুল তথ্য তৈরি করতে পারায় মানব বক্তাদেরও ছাড়িয়ে যেতে পারে’।

কিন্তু সমস্যা হলো, এই প্রভাবশালী তথ্যের উল্লেখযোগ্য অংশই ছিল ভুল। গবেষণায় উঠে এসেছে, চ্যাটবটগুলির প্রায় ১৯ শতাংশ দাবি ছিল ‘প্রধানত ভুল’। আরও উদ্বেগজনক, তুলনামূলক নতুন ও বড় মডেলগুলোর তথ্যভুল ছিল পুরনো মডেলগুলির তুলনায় বেশি। ওপেনএআইয়ের GPT-4.5 মডেলের ভুলের হার ছিল ছোট ও পুরনো মডেলের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। গবেষকদের কড়া সতর্কবার্তা, প্রভাব বিস্তারের তাগিদ সত্যের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য করছে এই প্রযুক্তিগুলিকে।

এই পরিস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য গভীর বিপদের ইঙ্গিত দেয়। কারণ প্রভাব বিস্তারে দক্ষ, কিন্তু সত্য যাচাইয়ে দুর্বল এআই চ্যাটবট যদি অসৎ রাজনৈতিক বা বিদেশি শক্তির হাতে পড়ে, তবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি, মেরুকরণ বৃদ্ধি বা অশান্তি উসকে দিতে তাদের ব্যবহার হওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র। গবেষণাপত্রের ভাষ্য, উচ্চমাত্রায় প্রভাবশালী এআই ‘র‌্যাডিক্যাল মতাদর্শ ছড়ানো বা রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে’।

এআইয়ের রাজনৈতিক ব্যবহার ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়ই এআই-নির্মিত ভিডিও বা ছবি ব্যবহার করছেন, বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহৃত হচ্ছে চ্যাটবট-লিখিত বার্তা, আর চিন-রাশিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলি প্রোপাগান্ডায় এআই-নির্ভর কনটেন্ট ছড়াচ্ছে। একই সঙ্গে সমীক্ষা বলছে, আমেরিকার প্রায় ৪৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নিয়মিত এআই টুল ব্যবহার করেন, যা এআই-নির্ভর প্রভাবের সম্ভাবনা আরও বাড়ায়।

গবেষণাটি একসঙ্গে হতাশা এবং আশার বার্তা দেয়। হতাশা— কারণ বিস্তারিত তথ্য-সমৃদ্ধ কথোপকথন মানুষকে প্রভাবিত করতে এতটাই সক্ষম যে ভুল তথ্যও সহজে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে। আবার আশার দিক—গবেষকেরাই বলছেন, ভয়ঙ্কর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মানুষকে ‘হিপনোটাইজ’ করার ক্ষমতা এখনও এআইয়ের নেই। মানুষ বিশ্বাস করে বিশদ, সংগঠিত তথ্যকে—এমন সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের মূল মূল্যবোধের পক্ষেই।

তবু প্রশ্ন থেকেই যায়: যখন উভয় পক্ষই এআইকে ব্যবহার করবে, তখন কি প্রভাব একে অপরকে বাতিল করবে—নাকি বিশৃঙ্খলা বাড়াবে? যখন সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক মত গঠনে ক্রমশ এআইয়ের মুখাপেক্ষী হচ্ছে, তখন কি ব্যক্তিগত বিচারবোধ ক্ষীণ হয়ে পড়বে? এবং সত্যের জায়গা দখল করবে সুচতুরভাবে সাজানো ‘তথ্যের আধিক্য’?

গবেষণাটি স্পষ্ট করছে যে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ রক্ষায় এখনই প্রয়োজন এআই-এর রাজনৈতিক ব্যবহারে কঠোর নীতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। নাহলে মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে তৈরি হবে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা—যেখানে সিদ্ধান্ত নেবে মানুষ নয়, তথ্যবিকৃতির অদৃশ্য যন্ত্র।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন