২০২৫ সালে এসে আমেরিকার স্বাস্থ্যভিত্তিক ভিসা নীতি তুলনামূলকভাবে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক হলেও, এর ভিতরে এখনও রাষ্ট্রের উদ্বেগ স্পষ্ট। লিখছেন তুষার
এক সময়ে আমেরিকার ভিসা নীতি শুধু অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, শরীরের অবস্থাও নির্ধারণ করত কে ‘যোগ্য’ নাগরিক হতে পারবে, আর কে নয়। স্বাস্থ্য তখন কেবল ব্যক্তিগত বিষয় ছিল না, বরং রাষ্ট্রের নৈতিক ও নিরাপত্তার প্রশ্নে পরিণত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি সেই ভাবনাকেই বছরের পর বছর ধরে বহন করেছে। ১৯৫০-এর দশক থেকে শুরু করে বর্তমান দিন পর্যন্ত এই নীতির বিবর্তন আমাদের সামনে তুলে ধরে—কীভাবে এক দেশের স্বাস্থ্যনীতি আসলে তার সমাজবোধ, মানবাধিকারের ধারণা, এমনকি বৈজ্ঞানিক চিন্তার পরিণতিও প্রতিফলিত করে।
শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে, যখন রোগকে শত্রু আর রোগীকেও প্রায় অপরাধী ভাবা হতো, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা আইনে সংক্রামক রোগের তালিকা তৈরি করতে থাকে। যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, গনোরিয়া, সিফিলিসের মতো রোগে আক্রান্ত কেউই আমেরিকার সীমান্ত পেরোতে পারত না। এই আইনের পেছনে যুক্তি ছিল জনস্বাস্থ্য রক্ষা, কিন্তু বাস্তবে এটি প্রায়ই সামাজিক বৈষম্য ও কলঙ্কের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে, ১৯৮৭ সালে যখন এইডস আক্রান্তদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়, তখন আমেরিকা এক ধরনের বৈজ্ঞানিক অজ্ঞতা ও ভীতির রাজনীতিতে আটকে পড়ে। একজন মানুষ তার রোগের জন্য ‘অযোগ্য’ ঘোষিত হচ্ছিল নাগরিক হওয়ার অধিকার থেকে—এ যেন আধুনিক সভ্যতার মধ্যেও মধ্যযুগীয় বিভাজনের এক ছায়া।
তবে ইতিহাসের গতিপথ এক জায়গায় থেমে থাকে না। ২০০৯ সালে ওবামা প্রশাসন HIV-নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়—এ এক নৈতিক জয়, মানবাধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে শুরু করে, রোগ কোনও অপরাধ নয়, আর স্বাস্থ্যের প্রশ্নে বৈষম্য আসলে সভ্যতার মুখে চপেটাঘাত। এই নীতিপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমেরিকা এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছিল—স্বাস্থ্যসুরক্ষা মানে শুধু রোগ ঠেকানো নয়, মানুষের মর্যাদাও রক্ষা করা।
কিন্তু কোভিড-১৯ যেন আবার সেই পুরোনো ভয়কে ফিরিয়ে আনল। বিশ্বজুড়ে সীমান্ত বন্ধ হলো, টিকা না নিলে ভিসা বন্ধ, আর প্রতিটি মানুষের শরীর পরিণত হলো এক সম্ভাব্য ‘ঝুঁকির’ বস্তুতে। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা প্রার্থীদের জন্য কোভিড টিকা বাধ্যতামূলক করে, যা জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিতে যথাযথ হলেও এক অর্থে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর প্রশ্ন তোলে। রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রয়াসের আড়ালে রাষ্ট্রের নজরদারি আরও গাঢ় হয়। মানুষের শরীর যেন রাষ্ট্রের নথিতে পরিণত হলো—কোন টিকা নিয়েছ, কবে অসুস্থ হয়েছ, কোন দেশে ছিলে।
আজ ২০২৫ সালে এসে আমেরিকার স্বাস্থ্যভিত্তিক ভিসা নীতি তুলনামূলকভাবে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক হলেও, এর ভিতরে এখনও রাষ্ট্রের উদ্বেগ স্পষ্ট। এখন আর HIV বা কোভিড সংক্রমণ ভিসা প্রত্যাখ্যানের কারণ নয়, কিন্তু মেডিক্যাল সার্টিফিকেট ছাড়া অভিবাসন অসম্ভব। সংক্রামক রোগ, মানসিক স্বাস্থ্য, টিকা রেকর্ড, আর্থিক সামর্থ্য—সবকিছুতেই এক প্রকার ‘নিয়ন্ত্রণের প্রশাসন’ কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আজ আর ‘রোগী’কে নিষিদ্ধ করে না, কিন্তু সে এখনও তাকে সন্দেহের চোখে দেখে।
তবু এই পরিবর্তনের মধ্যে আশার আলোও রয়েছে। আজকের নীতিতে আমরা অন্তত মানবাধিকারের কিছু প্রতিফলন দেখতে পাই—স্বাস্থ্য এখন আর নাগরিকত্বের দেয়াল নয়, বরং প্রবেশের পূর্বশর্ত মাত্র। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—রাষ্ট্র কি কখনও তার নাগরিককে সম্পূর্ণভাবে শরীরের ঊর্ধ্বে, কেবল মানুষ হিসেবে দেখতে পারবে?
আমেরিকার ভিসা নীতির এই দীর্ঘ পথচলা আসলে বিশ্ব রাজনীতির একটি প্রতিচ্ছবি। সংক্রামক রোগের ভয়, বিজ্ঞানভিত্তিক জননীতি, মানবাধিকার, আর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ—সব মিলিয়ে এটি এক জটিল সামাজিক রসায়ন। একদিকে এটি জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করে, অন্যদিকে মানুষের গোপনীয়তা ও স্বাধীনতার ওপর অজান্তে ছায়া ফেলে। রাষ্ট্র আর শরীর—এই দুইয়ের সম্পর্ক তাই চিরকালই অস্পষ্ট, কখনও যত্নের, কখনও নজরদারির।
স্বাস্থ্যকে যদি আমরা সত্যিই মানবাধিকারের অংশ হিসেবে মানি, তবে ভিসা নীতি শুধু রোগের তালিকা নয়, এক নতুন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র তার নীতিতে যে পরিবর্তনের পথ দেখিয়েছে, তা হয়তো একদিন গোটা বিশ্বকে শেখাবে—একজন মানুষকে মাপার মাপকাঠি তার শরীর নয়, তার মর্যাদা।
![]() |
| স্টক ইমেজ। পিক্সেল। |
এক সময়ে আমেরিকার ভিসা নীতি শুধু অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, শরীরের অবস্থাও নির্ধারণ করত কে ‘যোগ্য’ নাগরিক হতে পারবে, আর কে নয়। স্বাস্থ্য তখন কেবল ব্যক্তিগত বিষয় ছিল না, বরং রাষ্ট্রের নৈতিক ও নিরাপত্তার প্রশ্নে পরিণত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি সেই ভাবনাকেই বছরের পর বছর ধরে বহন করেছে। ১৯৫০-এর দশক থেকে শুরু করে বর্তমান দিন পর্যন্ত এই নীতির বিবর্তন আমাদের সামনে তুলে ধরে—কীভাবে এক দেশের স্বাস্থ্যনীতি আসলে তার সমাজবোধ, মানবাধিকারের ধারণা, এমনকি বৈজ্ঞানিক চিন্তার পরিণতিও প্রতিফলিত করে।
শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে, যখন রোগকে শত্রু আর রোগীকেও প্রায় অপরাধী ভাবা হতো, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা আইনে সংক্রামক রোগের তালিকা তৈরি করতে থাকে। যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, গনোরিয়া, সিফিলিসের মতো রোগে আক্রান্ত কেউই আমেরিকার সীমান্ত পেরোতে পারত না। এই আইনের পেছনে যুক্তি ছিল জনস্বাস্থ্য রক্ষা, কিন্তু বাস্তবে এটি প্রায়ই সামাজিক বৈষম্য ও কলঙ্কের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে, ১৯৮৭ সালে যখন এইডস আক্রান্তদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়, তখন আমেরিকা এক ধরনের বৈজ্ঞানিক অজ্ঞতা ও ভীতির রাজনীতিতে আটকে পড়ে। একজন মানুষ তার রোগের জন্য ‘অযোগ্য’ ঘোষিত হচ্ছিল নাগরিক হওয়ার অধিকার থেকে—এ যেন আধুনিক সভ্যতার মধ্যেও মধ্যযুগীয় বিভাজনের এক ছায়া।
তবে ইতিহাসের গতিপথ এক জায়গায় থেমে থাকে না। ২০০৯ সালে ওবামা প্রশাসন HIV-নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়—এ এক নৈতিক জয়, মানবাধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে শুরু করে, রোগ কোনও অপরাধ নয়, আর স্বাস্থ্যের প্রশ্নে বৈষম্য আসলে সভ্যতার মুখে চপেটাঘাত। এই নীতিপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমেরিকা এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছিল—স্বাস্থ্যসুরক্ষা মানে শুধু রোগ ঠেকানো নয়, মানুষের মর্যাদাও রক্ষা করা।
কিন্তু কোভিড-১৯ যেন আবার সেই পুরোনো ভয়কে ফিরিয়ে আনল। বিশ্বজুড়ে সীমান্ত বন্ধ হলো, টিকা না নিলে ভিসা বন্ধ, আর প্রতিটি মানুষের শরীর পরিণত হলো এক সম্ভাব্য ‘ঝুঁকির’ বস্তুতে। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা প্রার্থীদের জন্য কোভিড টিকা বাধ্যতামূলক করে, যা জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিতে যথাযথ হলেও এক অর্থে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর প্রশ্ন তোলে। রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রয়াসের আড়ালে রাষ্ট্রের নজরদারি আরও গাঢ় হয়। মানুষের শরীর যেন রাষ্ট্রের নথিতে পরিণত হলো—কোন টিকা নিয়েছ, কবে অসুস্থ হয়েছ, কোন দেশে ছিলে।
আজ ২০২৫ সালে এসে আমেরিকার স্বাস্থ্যভিত্তিক ভিসা নীতি তুলনামূলকভাবে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক হলেও, এর ভিতরে এখনও রাষ্ট্রের উদ্বেগ স্পষ্ট। এখন আর HIV বা কোভিড সংক্রমণ ভিসা প্রত্যাখ্যানের কারণ নয়, কিন্তু মেডিক্যাল সার্টিফিকেট ছাড়া অভিবাসন অসম্ভব। সংক্রামক রোগ, মানসিক স্বাস্থ্য, টিকা রেকর্ড, আর্থিক সামর্থ্য—সবকিছুতেই এক প্রকার ‘নিয়ন্ত্রণের প্রশাসন’ কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আজ আর ‘রোগী’কে নিষিদ্ধ করে না, কিন্তু সে এখনও তাকে সন্দেহের চোখে দেখে।
তবু এই পরিবর্তনের মধ্যে আশার আলোও রয়েছে। আজকের নীতিতে আমরা অন্তত মানবাধিকারের কিছু প্রতিফলন দেখতে পাই—স্বাস্থ্য এখন আর নাগরিকত্বের দেয়াল নয়, বরং প্রবেশের পূর্বশর্ত মাত্র। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—রাষ্ট্র কি কখনও তার নাগরিককে সম্পূর্ণভাবে শরীরের ঊর্ধ্বে, কেবল মানুষ হিসেবে দেখতে পারবে?
আমেরিকার ভিসা নীতির এই দীর্ঘ পথচলা আসলে বিশ্ব রাজনীতির একটি প্রতিচ্ছবি। সংক্রামক রোগের ভয়, বিজ্ঞানভিত্তিক জননীতি, মানবাধিকার, আর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ—সব মিলিয়ে এটি এক জটিল সামাজিক রসায়ন। একদিকে এটি জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করে, অন্যদিকে মানুষের গোপনীয়তা ও স্বাধীনতার ওপর অজান্তে ছায়া ফেলে। রাষ্ট্র আর শরীর—এই দুইয়ের সম্পর্ক তাই চিরকালই অস্পষ্ট, কখনও যত্নের, কখনও নজরদারির।
স্বাস্থ্যকে যদি আমরা সত্যিই মানবাধিকারের অংশ হিসেবে মানি, তবে ভিসা নীতি শুধু রোগের তালিকা নয়, এক নতুন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র তার নীতিতে যে পরিবর্তনের পথ দেখিয়েছে, তা হয়তো একদিন গোটা বিশ্বকে শেখাবে—একজন মানুষকে মাপার মাপকাঠি তার শরীর নয়, তার মর্যাদা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন