নানা মহলের তীব্র নিন্দায় কোণঠাসা হয়ে শেষ পর্যন্ত ভিডিয়োবার্তায় ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন মন্ত্রী।
![]() |
| গর্গ চট্টোপাধ্যায়। ফাইল ছবি। |
কলকাতা : ভারতের নবজাগরণের অন্যতম স্থপতি রাজা রামমোহন রায়কে ‘ব্রিটিশদের দালাল’ এবং ‘ভুয়ো সমাজ সংস্কারক’ বলে মন্তব্য করে তীব্র বিতর্কে জড়ান মধ্যপ্রদেশের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী ইন্দর সিং পরমার। বিরসা মুন্ডা জয়ন্তীর একটি অনুষ্ঠানে এই মন্তব্য করার সঙ্গে সঙ্গেই দেশজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। নানা মহলের তীব্র নিন্দায় কোণঠাসা হয়ে শেষ পর্যন্ত ভিডিয়োবার্তায় ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলেন মন্ত্রী।
মন্ত্রী পারমারের মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় বাংলা পক্ষ। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক গর্গ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এই মন্তব্যেই স্পষ্ট, হিন্দি বলয়ে বাঙালিদের প্রতি কতটা ঘৃণা ও ভুল ধারণা প্রচলিত। যারা ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, তাদের কাছ থেকে বাঙালি মনীষীদের এই ধরনের অপমান প্রাপ্য নয়। আজ বিজেপি রামমোহনকে কুৎসা করছে, রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করছে, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙছে, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’-এর শব্দ বদলে দিচ্ছে। হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির মাধ্যমে বাংলাকে চেপে ধরার এই চেষ্টাকে মানুষ কখনও মেনে নেবে না।”
প্রসঙ্গত, অনুষ্ঠানে পারমার দাবি করেন, ব্রিটিশরা নিজেদের স্বার্থে ‘ভুয়ো সমাজ সংস্কারক’ তৈরি করেছিল, যার মধ্যে রাজা রামমোহন রায় অন্যতম। তাঁর আরও বক্তব্য, ইংরেজি শিক্ষার আড়ালে ধর্মান্তরণের উদ্দেশ্য লুকিয়ে ছিল, যার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন বিরসা মুন্ডা। মিশনারি স্কুলগুলিকে তিনি ধর্মান্তরণের হাতিয়ার বলেও উল্লেখ করেন।
এই মন্তব্য সামনে আসতেই রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিবাদ জানায়। দলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, “বাংলার গর্ব রামমোহনকে দালাল বলা মানে বাংলার নবজাগরণ ও ভারতের জেগে ওঠার চেতনাকে অপমান করা। বিজেপির ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস নেই বলেই তারা এমন কথা বলতে পারে।” কুণালের তীব্র প্রশ্ন—“রামমোহনের নেতৃত্বে যে সতীদাহ প্রথা রদ হয়েছিল, তা কি বিজেপি সমর্থন করছে?”
তৃণমূল তাদের সামাজিক মাধ্যমে লিখেছে, “বাংলার মনীষীদের প্রতি বিজেপির ঘৃণার সীমা নেই।” দলের মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী ক্ষোভ উগরে দিয়ে লেখেন, “আমার রাম রামমোহন, আমার ঈশ্বর বিদ্যাসাগর, আমার ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ। তুই আমাদের দেবতাদের অপমান করিস, তুই বিজেপি।” সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, “যারা নিজেরাই ব্রিটিশদের দালালি করেছে, তারাই আজ রামমোহনকে দালাল বলছে।”
কংগ্রেসও পারমারের মন্তব্যকে 'লজ্জাজনক' বলে আক্রমণ শানায়। দলের মুখপাত্র ভূপেন্দ্র গুপ্ত প্রশ্ন তোলেন, “সতীদাহ প্রথা রদ কি তাহলে ব্রিটিশদের দালালি?” তাঁর অভিযোগ, ইতিহাস সম্বন্ধে ন্যূনতম ধারণাও নেই এই মন্ত্রীর।
ক্ষোভ বাড়তে থাকায় মধ্যপ্রদেশ বিজেপিও পারমারের বক্তব্য থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শিবম শুক্লা বলেন, “এটি সম্পূর্ণ মন্ত্রীর ব্যক্তিগত মত। দেশের সকল মহান নেতার প্রতি বিজেপির শ্রদ্ধা রয়েছে।”
শেষ পর্যন্ত রবিবার ভিডিয়োবার্তা দিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেন পারমার। তিনি বলেন, “বিরসা মুন্ডা সম্পর্কে বলার সময়ে ভুলবশত রামমোহন সম্পর্কে ভুল মন্তব্য করেছি। এর জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।” তিনি রামমোহনকে “বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক” বলেও স্বীকার করেন।
উনিশ শতকে সতীদাহ প্রথা রদ, নারীশিক্ষার প্রসার, যুক্তিবাদী দর্শন ও ধর্মীয় সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে অনস্বীকার্য। এমন একজন মনীষীকে ‘ব্রিটিশ দালাল’ বলে অপমান করার ঘটনায় ফের উত্তপ্ত হয়েছে বাংলার রাজনীতি। ক্ষমা চেয়েও মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রীকে ঘিরে বিতর্ক থামছে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন