রাজ্য রাজনীতির অন্যতম সবচেয়ে প্রভাবশালী এই পরিবারের ভিতরে বিভাজন যে ক্রমশ বাড়ছে, তাঁদের এই সিদ্ধান্ত সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
![]() |
| সুখের সেদিন। যাদব পরিবার। ফাইল ছবি। |
পাটনা : বিহার বিধানসভা নির্বাচনে আরজেডির ভয়াবহ পরাজয়ের পর থেকেই লালু প্রসাদ যাদবের পরিবারের অন্দরে শুরু হয়েছে মারাত্মক টানাপড়েন। রোহিণী আচারিয়ার বিস্ফোরক মন্তব্য এবং পরিবার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্তের মাত্র একদিন পরেই আরও তিন মেয়ে—রাজলক্ষ্মী, রাগিনী ও চন্দা— সন্তানদের নিয়ে পাটনার বাসভবন ছেড়ে দিল্লি পাড়ি দিয়েছেন। রাজ্য রাজনীতির অন্যতম সবচেয়ে প্রভাবশালী এই পরিবারের ভিতরে বিভাজন যে ক্রমশ বাড়ছে, তাঁদের এই সিদ্ধান্ত সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
বিহার নির্বাচনে আরজেডির আসন সংখ্যা ৭৫ থেকে কমে প্রায় ২৫-এ নেমে আসার পর থেকেই দলে এবং পরিবারে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে শুরু হয় অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণ। সিঙ্গাপুরে থাকা ডাক্তার রোহিণী ভোট পরাজয়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঘোষণা করেন, তিনি রাজনীতি ছাড়ছেন এবং পরিবার থেকেও নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন। আবেগঘন একাধিক পোস্টে তিনি অভিযোগ করেন, তাঁকে অশ্রাব্য গালাগাল দেওয়া হয়েছে, এমনকি একসময়ে তাঁকে চটি দিয়ে মারার চেষ্টাও করা হয়। অভিযোগের কেন্দ্রে ছিলেন তেজস্বী যাদবের দুই ঘনিষ্ঠ—রাজ্যসভার সাংসদ সঞ্জয় যাদব এবং তাঁর দীর্ঘদিনের সহচর রামিজ।
রোহিণীর দাবি, তাঁকে অপমান করে অভিযুক্ত করা হয়েছে যে, বাবাকে কিডনি দানের পর তিনি নাকি ‘কোটি কোটি টাকা নিয়েছেন’। এই অভিযোগকে ‘জঘন্য মিথ্যে’ বলে ঘটনাটিকে দুঃসহ অপমান হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। আরেক পোস্টে রোহিণী লেখেন, “সঞ্জয় যাদব ও রামিজ যা করতে বলেছিল, আমি তাই করলাম। সব দোষ আমাকেই নিতে হয়েছে।” অভিযুক্তদের কেউই প্রতিক্রিয়া না দেওয়ায় তেজস্বী ঘিরে ক্ষমতার লড়াইয়ের জল্পনা আরও জোরাল হয়েছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই চুপচাপ ১০ সার্কুলার রোডের সরকারি বাসভবন ছেড়ে চলে যান রাজলক্ষ্মী, রাগিনী ও চান্দা। পরিবারসূত্রে জানা গেছে, গত দুই দিনের ঘটনাবলি তাঁদের গভীরভাবে ব্যথিত করেছে। এখন ওই বাড়িতে রয়েছেন কেবল লালু প্রসাদ যাদব, রাবড়ি দেবী এবং মিসা ভারতী। তেজস্বী যাদব ইতিমধ্যেই জনসমক্ষে খুব কম দেখা দিচ্ছেন। পরাজয়ের পর তাঁর নেতৃত্ব, কৌশল এবং ঘনিষ্ঠদের ভূমিকা নিয়ে দলে অসন্তোষ তুঙ্গে।
রোহিণীর বিরুদ্ধে অপমানের অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতেই প্রতিক্রিয়া জানান তেজ প্রতাপ যাদব। পারিবারিক বিবাদের জেরে তিনি আগেই দল ও পরিবার থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। জংশক্তি জনতা দলের সামাজিক মাধ্যমে তিনি লেখেন, ঘটনাটি তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ করেছে। নিজের বিরুদ্ধে বহু অপমান সয়ে নিলেও বোনের অসম্মান কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না বলে তেজ প্রতাপ হুঁশিয়ারি দেন। লালু প্রসাদকে উদ্দেশ করে তিনি লিখেছেন, “বাবা, শুধু ইশারা দিন। বিহারের মানুষ এসব ‘জয়চাঁদদের’ কবর দেবে।” তাঁর অভিযোগ, কয়েকজন ব্যক্তি তেজস্বীর সিদ্ধান্তগ্রহণে অস্বাভাবিক প্রভাব খাটাচ্ছে এবং এখন লড়াইটা মেয়ের সম্মান আর বিহারের আত্মমর্যাদার।
তেজ প্রতাপের আগের বিতর্ক, বিবাহবিচ্ছেদ মামলা, এবং আরজেডি ছাড়ার পর নিজস্ব দল গঠন—সবকিছু মিলিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিবারের সম্পর্ক আগেই টানাপড়েনপূর্ণ ছিল। এখন রোহিণীর প্রস্থান সেই ভাঙনকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
লালু-রাবড়ি দম্পতির সাত মেয়ে ও দুই ছেলেসহ বিশাল পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরেই বিহারের রাজনৈতিক কেন্দ্রে অবস্থান করছে। মেয়েরা প্রত্যেকেই প্রভাবশালী পরিবারে বিবাহিত—রোহিণীর স্বামী সমরেশ সিংহ, চান্দার স্বামী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের পাইলট বিক্রম সিংহ, রাগিনী সমাজবাদী পার্টি নেতা রাহুল যাদবের স্ত্রী, হেমার স্বামী বীনীত যাদব, অনুষ্কার স্বামী চিরঞ্জীব রাও, আর সর্বকনিষ্ঠ রাজলক্ষ্মী বিবাহিত তেজ প্রতাপ সিংহ যাদবের সঙ্গে।
পরিবার ও দলের এই অস্থিরতার মূল প্রেক্ষাপট আরজেডির ভয়াবহ নির্বাচনী পতন। মহাগঠবন্ধনের মোট আসন সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৫-এ। দলের ভেতরে এখন চাপ বাড়ছে তেজস্বী যাদবের নির্বাচনী কৌশল, তাঁর ঘনিষ্ঠদের প্রভাব এবং নির্বাচনপূর্ব তড়িঘড়ি ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে। সব মিলিয়ে আরজেডি-র রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ যেমন অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তেমনই লালু পরিবারের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কও এখন গভীর সঙ্কটে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন