তীব্র মার্কিন ট্যারিফেও জিডিপি বৃদ্ধি ৮.২%

অর্থনীতির এই গতি মূলত ব্যক্তিগত ভোগের বৃদ্ধি ও শিল্পোৎপাদনের জোরদার পুনরুদ্ধারের ফল। 

তীব্র মার্কিন ট্যারিফেও জিডিপি বৃদ্ধি ৮.২%

নয়াদিল্লি : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত কঠোর শুল্ক চাপের মাঝেই জুলাই–সেপ্টেম্বর ২০২৫ ত্রৈমাসিকে ভারতের অর্থনীতি ছ’ত্রৈমাসিকের সর্বোচ্চ গতি অর্জন করেছে। জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর (NSO) শুক্রবার যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ২০২৫-২৬ আর্থিক বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধি পৌঁছেছে ৮.২ শতাংশে। প্রথম ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার ছিল ৭.৮ শতাংশ এবং গত বছরের একই সময়ে ছিল ৫.৪ শতাংশ। বাজার অনুমানের তুলনায় এটি অনেক বেশি—রয়টার্স যেখানে ৭.৩ শতাংশ ধারণা করেছিল, এসবিআই রিসার্চ ৭.৫ শতাংশ এবং ব্লুমবার্গ ৭.৪ শতাংশ বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়।

অর্থনীতির এই গতি মূলত ব্যক্তিগত ভোগের বৃদ্ধি ও শিল্পোৎপাদনের জোরদার পুনরুদ্ধারের ফল। ব্যক্তিগত খরচ বছরওয়ারি ৭.৯ শতাংশ বেড়েছে, যা গত ত্রৈমাসিকের ৭ শতাংশের তুলনায় উল্লেখযোগ্য। উৎপাদন খাতে বৃদ্ধি হয়েছে ৯.১ শতাংশ, প্রথম ত্রৈমাসিকের ৭.৭ শতাংশ থেকে আরও ধাক্কা দিয়ে ওপরে উঠেছে। নির্মাণশিল্পে বৃদ্ধি কিছুটা মন্থর—এই ত্রৈমাসিকে ৭.২ শতাংশ, আগের ত্রৈমাসিকের ৭.৬ শতাংশের তুলনায় খানিক কম। তবে উদ্বেগের জায়গা সরকারি ব্যয়—যা এ সময়ে ২.৭ শতাংশ কমেছে, যদিও আগের ত্রৈমাসিকে সরকারি ব্যয় বেড়েছিল ৭.৪ শতাংশ।

এমকেই গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসেস-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ মাধবী অরোরা জানিয়েছেন, অনুকূল ডিফ্লেটর, মুদ্রানীতি ও নিয়ন্ত্রক শিথিলতার প্রভাব এবং মার্কিন ট্যারিফের সীমিত প্রভাব—এই সব মিলিয়েই বৃদ্ধির গতি বাড়িয়েছে। তাঁর মতে, ভোক্তা চাহিদার আরও উন্নতির সঙ্গে এই ধারা তৃতীয় ত্রৈমাসিকেও অব্যাহত থাকতে পারে এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বৃদ্ধিকে ৭ শতাংশের আশেপাশে ধরে রাখতে সাহায্য করবে।

মার্কিন বাণিজ্য নীতির চাপ ও ঘরোয়া বড় নীতি পরিবর্তনের মাঝেই ভারতের এই ‘স্থিতিস্থাপকতা’ নজরকাড়া। ২৩ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে—কারণ হিসেবে দেখানো হয় ভারতের আমদানি-নিষেধাজ্ঞা এবং রাশিয়ার তেল কেনা। ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, রাশিয়ার তেল কিনে ভারত পরোক্ষে ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কোকে সাহায্য করছে। এর ঠিক এক মাস পর, ২২ সেপ্টেম্বর চালু হয় জিএসটি ২.০—যেখানে সাবান থেকে ছোট গাড়ি পর্যন্ত শতাধিক ভোক্তা পণ্যের ওপর কর কমানো হয়। এই নীতি পরিবর্তনের সম্পূর্ণ প্রভাব জিডিপি-র ত্রৈমাসিক তথ্যের মধ্যে এখনও পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়নি।

এদিকে অক্টোবর ২০২৫-এ মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে নজিরবিহীন ০.২৫ শতাংশে। তবে একই সময়ে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে পৌঁছেছে ৪১.৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে, মূলত আমেরিকায় পণ্য রফতানি কমে যাওয়ার ফলে। ডিবিএস ব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদ রাধিকা রাও জানিয়েছেন, ডিসেম্বরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মুদ্রানীতি কমিটিকে কঠিন সমীকরণের মুখোমুখি হতে হবে—একদিকে জোরদার বৃদ্ধি, অন্যদিকে অতি-নিম্ন মূল্যস্ফীতি। তিনি মনে করেন উচ্চ ‘রিয়াল ইন্টারেস্ট রেট’-এর কারণে আরও সুদ কমানোর যুক্তিও সামনে আসতে পারে।

এমন সময় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ভারতের পরিসংখ্যানের মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের বার্ষিক পর্যালোচনায় ভারতের জাতীয় হিসাবের তথ্যকে দেওয়া হয়েছে ‘সি’ গ্রেড—যা সংস্থাটির দ্বিতীয়-নিম্ন বিভাগ। আইএমএফ বলেছে, ভারতের পরিসংখ্যান ব্যবস্থায় ‘মৌলিক দুর্বলতা’ রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মূল্যায়নের মানদণ্ড পূরণ করে না। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের জিডিপি তথ্য প্রকাশের আগেই এই মূল্যায়ন প্রকাশ হওয়ায় নয়াদিল্লিতে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।

আইএমএফ-এর আর্টিকেল IV রিপোর্টে ভারতের জিডিপি ও জিভিএ (GVA) পরিমাপ পদ্ধতি নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বিরোধী দলগুলি বরাবরই মোদি সরকারের আমলে অর্থনৈতিক তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি, আইএমএফ-এর মন্তব্য সেই অভিযোগকে শক্তিশালী করেছে। সংসদে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এতদিন এই বিতর্ককে চাপা রেখেছিল, তবে আন্তর্জাতিক নজরদারি নতুন করে সরকারকে চাপে ফেলেছে।

বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা ও নীতি-বদলের মাঝেও ভারত যখন শক্তিশালী বৃদ্ধির উদযাপন করছে, তখন একইসঙ্গে তথ্য-স্বচ্ছতা ও পরিসংখ্যানের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে বিতর্কও ফের তীব্র হয়েছে—যা আগামী মাসগুলোতে অর্থনীতি ও রাজনীতির দুই ক্ষেত্রেই তর্ক-বিতর্ককে আরও তপ্ত করে তুলতে পারে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন