অভিযাত্রীদের কারও মাথার খুলি ফাটা, বুকের পাঁজর ভাঙা, কারও চোখ বা জিহ্বা উধাও, ডায়াটলভ রহস‌্য আজও অজানা

কিছু দেহে অদ্ভুত তেজস্ক্রিয়তার চিহ্নও পাওয়া যায়। এসব মিলিয়ে রহস্য আরও ঘনীভূত হয়।

অভিযাত্রীদের কারও মাথার খুলি ফাটা,  বুকের পাঁজর ভাঙা, কারও চোখ বা জিহ্বা উধাও, ডায়াটলভ রহস‌্য আজও অজানা

রাশিয়ার উরাল পর্বতের গভীরে, সাদা বরফে ঢাকা পাহাড়ি পথে ১৯৫৯ সালের শীতের এক অদ্ভুত রাত ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের শীতল আবহে গড়ে ওঠা সেই কাহিনী আজও অমীমাংসিত থেকে গেছে। একে বলা হয় “ডায়াটলভ পাস ইন্সিডেন্ট”—যেখানে নয়জন তরুণ হাইকার অদ্ভুত পরিস্থিতিতে প্রাণ হারান, আর রেখে যান একের পর এক অস্বস্তিকর প্রশ্ন, যেগুলোর উত্তর মেলেনি এত দশকেও।

তখন ফেব্রুয়ারি মাস। ইগর ডায়াটলভ নামের এক তরুণ প্রকৌশল শিক্ষার্থী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এক অভিযানে। তাঁর সঙ্গী ছিলেন আটজন ছাত্রছাত্রী, যাদের বয়স ছিল কুড়ি থেকে তিরিশের মধ্যে। তাঁরা প্রত্যেকেই অভিজ্ঞ ট্রেকার, সোভিয়েত মানদণ্ডে শীর্ষস্তরের পার্বত্য অভিযানের অনুমোদনপ্রাপ্ত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল উরাল পাহাড়ের ওটর্টেন চূড়ায় পৌঁছানো। নামের অর্থ স্থানীয় মানসি ভাষায় “মৃত্যুর পাহাড়”—যা হয়তো ছিল এক অশুভ ইঙ্গিত।

অভিযাত্রী দল তাদের পথচলা শুরু করে জানুয়ারির শেষদিকে। শুরুর কয়েকদিন ছিল স্বাভাবিক। তারা বরফঢাকা জঙ্গল পেরিয়ে এগোচ্ছিল, ক্যাম্প বসাচ্ছিল, ডায়েরিতে লিখছিল, ছবি তুলছিল। সেই ছবিগুলোতে দেখা যায় হাস্যোজ্জ্বল মুখ, গান বাজনা, নিস্তব্ধ সাদা পৃথিবীর বুকে তারুণ্যের দীপ্তি। কিন্তু ১ ফেব্রুয়ারির রাতে হঠাৎ করেই সবকিছু পাল্টে গেল।

তাঁদের তাঁবুটি পরে উদ্ধার করা হয়েছিল পাহাড়ের ঢালে। অদ্ভুত ব্যাপার, তাঁবুর কাপড় ভেতর থেকে ছেঁড়া, যেন অভিযাত্রীরা ভেতর থেকে আতঙ্কে ছুটে বেরিয়ে গেছে। বাইরে বরফের উপর পাওয়া গেল তাদের পায়ের ছাপ, যেগুলো খালি পায়ে বা মাত্র মোজা পরে ফেলা হয়েছিল। তুষারঝড় আর হাড়কাঁপানো ঠান্ডায়—যেখানে শরীর কয়েক মিনিটে জমে যেতে পারে—এমন কাজের ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন।

তাঁবু থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে প্রথমে উদ্ধার হয় দুই তরুণের লাশ, পাইন গাছের নিচে, আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করা হয়েছিল সেখানে। তাদের গায়ে প্রায় কিছুই ছিল না। আরও কয়েকশ মিটার দূরে পাওয়া গেল আরও তিনজনকে—তাদের কেউ পাহাড়ের দিকে ফেরার চেষ্টা করছিলেন। বাকিদের দেহ মিলল কয়েক সপ্তাহ পরে, গাঢ় বরফের নিচে, একটি গিরিখাতের ধারে। এদের মধ্যে কারও খুলি ফেটে গিয়েছিল, কারও বুক ভেঙে গিয়েছিল ভয়ঙ্কর শক্তির আঘাতে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বাইরের চামড়ায় তেমন ক্ষতচিহ্ন ছিল না। এক নারীর জিহ্বা আর চোখও অনুপস্থিত ছিল।

পোস্টমর্টেম রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, আঘাতগুলো এতটাই তীব্র ছিল যেন কোনো গাড়ি চাপা দিয়েছে, অথচ বাহ্যিক দাগ নেই। আবার কিছু দেহে অদ্ভুত তেজস্ক্রিয়তার চিহ্নও পাওয়া যায়। এসব মিলিয়ে রহস্য আরও ঘনীভূত হয়।

সরকারি তদন্ত শেষে বলা হয়, “একটি অজানা শক্তি” তাদের মৃত্যুর কারণ। কিন্তু কী সেই শক্তি—কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেনি। এর পর থেকেই জন্ম নেয় অসংখ্য তত্ত্ব। কেউ বলেন, তারা হয়তো তুষারধসে ভেসে গিয়েছিল। কেউ বলেন, গোপন সামরিক পরীক্ষার শিকার হয়েছিলেন তারা। কারও মতে, অদ্ভুত শব্দ তরঙ্গ বা “ইনফ্রাসাউন্ড” তাদের আতঙ্কিত করে তুলেছিল। আবার কেউ খুঁজে পান ইউএফও বা ভিনগ্রহীদের ছায়া। স্থানীয় মানসি উপজাতিরা বিশ্বাস করে, পাহাড়ে “অভিশপ্ত আত্মারা” বসবাস করে।

ডায়াটলভ পাস ঘটনা আজও ইন্টারনেটে আলোচনার ঝড় তোলে। ইউটিউবে, রেডিটে, ডকুমেন্টারিতে—প্রতিটি জায়গায় নানা নতুন থিওরি ভেসে বেড়ায়। কেউ ফটো আর ডায়েরির প্রতিটি শব্দ খুঁটিয়ে দেখে, কেউ বরফের পদার্থবিদ্যা ব্যাখ্যা করে, কেউ বা অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রমাণ খোঁজে। ষাট বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, তবুও রহস্যের সমাধান হয়নি।

সেই রাতের অন্ধকারে  আসলে কী ঘটেছিল? কেন অভিজ্ঞ অভিযাত্রীরা এতটা আতঙ্কিত হয়ে নিজেদের তাঁবু কেটে বেরিয়ে গেলেন? কারও মুখ থেকে কেন হারিয়ে গেল জিহ্বা? তাদের শরীরে অস্বাভাবিক আঘাতের রহস্য কী? প্রশ্নগুলো আজও ঝুলে আছে বরফের মতো জমাট হয়ে।

ডায়াটলভ পাসের বরফঢাকা ঢালে যখন হাওয়া বয়ে যায়, মনে হয় হয়তো তার সঙ্গে ভেসে আসে সেই রাতের আতঙ্কের প্রতিধ্বনি। মানুষ ভুলে গেলেও পাহাড় জানে—সে রাতে কী হয়েছিল। আর হয়তো সেটিই চিরকাল রহস্য হয়েই থাকবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন