‘দ্য ব্ল্যাক ডালিয়া’ : যে হত‌্যাকাণ্ড নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা আমেরিকাকে

‘দ্য ব্ল্যাক ডালিয়া মার্ডার’ সে সময় হয়ে ওঠে আমেরিকার প্রথম মিডিয়া-ক্রাইম সেনসেশন।

‘দ্য ব্ল্যাক ডালিয়া’ : যে হত‌্যাকাণ্ড নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা আমেরিকাকে

লস অ্যাঞ্জেলস। সিনেমা আর গ্ল্যামারে মোড়া হলিউডের আলোক ঝলমলে এক শহর। কিন্তু ১৯৪৭ সালের জানুয়ারির সেই ভোরে এই শহরই সাক্ষী হল এমন এক বিভীষিকাময় হত্যার, যা কেবল আমেরিকাই নয়, পুরো বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। ‘দ্য ব্ল্যাক ডালিয়া’ (The Black Dalia) নামে পরিচিত সেই রহস্য আজও আমেরিকার ক্রাইম ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ও অমীমাংসিত অধ্যায়গুলির একটি।

১৯৪০-এর দশকের লস অ্যাঞ্জেলস ছিল সপ্নভঙ্গের শহর। অগণিত তরুণ-তরুণী প্রতিদিন আসত হলিউডে তারকা হওয়ার আশায়, আলোর নিচে নিজের নাম খোদাই করতে। এলিজাবেথ শর্টও ছিল তাদেরই একজন। কালো চুল, উজ্জ্বল নীল চোখ, সাদা ত্বক, আর ঠোঁটে লালচে ছোঁয়া—এক অদ্ভুত মায়াবী আকর্ষণ ছিল মেয়েটির চেহারায়। বন্ধু ও পরিচিতরা ডাকত তাকে ‘ব্ল্যাক ডালিয়া’, কারণ সে সব সময় কালো পোশাক পরত আর তার ব্যক্তিত্বে ছিল এক অদ্ভুত রহস্যময়তা।

কিন্তু এলিজাবেথের জীবন ছিল একদম বিপরীত। দরিদ্র, অনিশ্চয়তা, প্রেমের ভাঙাচোরা সম্পর্ক, আর একাকীত্বে ভরা ছিল তাঁর দিনযাপন। হলিউডের স্টুডিওগুলিতে ঘুরে ঘুরে ছোটখাটো ভূমিকা পাওয়ার চেষ্টা করত, কিন্তু সাফল‌্য আসেনি। তবুও তাঁর মুখে হাসি থাকত, যেন সে নিজেই নিজের ট্র্যাজেডির দর্শক।

১৫ জানুয়ারি, ১৯৪৭। সকাল আটটা নাগাদ লস অ্যাঞ্জেলসের লিমার্ট পার্কের কাছে এক গৃহবধূ রাস্তার ধারে একটি ভয়ঙ্কর দৃশ‌্য দেখেন। মহিলা প্রথমে ভেবেছিলেন একটি ভাঙা ম্যানিকুইন—দু’টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। কিন্তু কাছে যেতেই তার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যায়। সেটি ছিল এক তরুণীর দেহ, মাঝ বরাবর কাটা, রক্তশূন্য মুখে ছিল এক বিকৃত। ঠোঁটের দুই প্রান্ত কাটা হয়েছিল কান পর্যন্ত।

পুলিশ যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছায়, চারপাশে ভিড় জমে যায়। সংবাদমাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়ে। এলিজাবেথ শর্ট, ২৫ বছর বয়সী যে তরুণী, কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ ছিল—সেই মেয়েটিই এখন শহরের আলোচনার কেন্দ্রে।

এই হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে ভয়ানক দিক ছিল এর নিখুঁত পরিকল্পনা। মৃতদেহ থেকে এক ফোঁটা রক্তও পাওয়া যায়নি, যা বোঝায়, খুনটি অন্য কোথাও হয়েছিল এবং পরে দেহটি সেখানে ফেলে যাওয়া হয়। দেহে কোনও দাগ বা আঙুলের ছাপ ছিল না। খুনির অদ্ভুত সাবধানতা পুলিশকে হতবাক করে দিয়েছিল।

তদন্তে উঠে আসে, এলিজাবেথের শরীরে ছিল শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন, কিন্তু ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি। খুনি যেন কোনও বিকৃত শিল্পী—যে নিজের ‘সৃষ্টি’কে গর্বের সঙ্গে প্রদর্শন করতে চেয়েছিল।

‘দ্য ব্ল্যাক ডালিয়া মার্ডার’ সে সময় হয়ে ওঠে আমেরিকার প্রথম মিডিয়া-ক্রাইম সেনসেশন। সংবাদপত্রগুলি প্রতিদিন নতুন নতুন তত্ত্ব ছাপতে থাকে। সে কি প্রাক্তন প্রেমিকের হাতে খুন? কোনও সাইকোপ্যাথ চিকিৎসকের কাজ? নাকি হলিউডের কোনও অভিজাত চক্রের ভয়ংকর গোপন রহস্য চাপা দেওয়ার চেষ্টা?

লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ শতাধিক সন্দেহভাজনকে জেরা করলেও, প্রমাণের অভাবে কেউই দোষী প্রমাণিত হয়নি। এমনকি কয়েকজন নিজেরাই পুলিশের কাছে গিয়ে স্বীকার করে—‘আমি ব্ল্যাক ডালিয়াকে খুন করেছি’—কিন্তু পরে প্রমাণ হয়, তারা মিথ্যা বলছে, কেবল বিখ্যাত হওয়ার জন্য।

বিগত দশকগুলিতে বহু তত্ত্ব উঠেছে। কেউ বলেন, এটি ছিল এক সাইকোপ্যাথ সার্জনের কাজ, যে মৃতদেহ নিয়ে ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করত। কেউ বলেন, এটি ছিল হলিউডের প্রভাবশালী লোকদের তৈরি বড় কোনও কেলেঙ্কারি চাপা দেওয়ার চেষ্টা। আবার অনেকেই বিশ্বাস করেন, পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে সত্য গোপন করেছিল, কারণ খুনি হয়তো কোনও প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য ছিল।

২০১৭ সালে সাবেক LAPD ডিটেকটিভ স্টিভ হডেল দাবি করেন, তার নিজের বাবা—ডঃ জর্জ হডেলই নাকি খুনি। তার বাড়ি থেকে পাওয়া গোপন ডায়েরিতে এমন কিছু সূত্র পাওয়া যায়, যা অনেকটা সেই ঘটনার সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু সরকারি ভাবে কিছুই প্রমাণিত হয়নি।

‘ব্ল্যাক ডালিয়া’ আজও আমেরিকান সংস্কৃতির এক অদ্ভুত প্রতীক। তার মৃত্যুর চেয়েও বেশি আলোচিত হয়ে উঠেছে তার জীবন, তার মুখের সেই হাসি, তার চোখের নীল শূন্যতা। হলিউডে একের পর এক সিনেমা, বই, ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছে এই ঘটনার ওপর।

এলিজাবেথ শর্টের প্রেতাত্মা প্রতিটি প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয়, গ্ল্যামারের শহরের আলো যত উজ্জ্বল হয়, তার অন্ধকারও তত গভীর হয়।

‘ব্ল্যাক ডালিয়া মার্ডার’ কেবল এক হত্যার গল্প নয়। এটি নারীর শরীর, সৌন্দর্য ও সমাজের বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গির এক নগ্ন প্রতিফলন। যে শহর তাঁকে তারকা হতে দেয়নি, সেই শহরই তাঁকে মৃত্যুর পর কিংবদন্তি করেছে—এক রক্তাক্ত ফুল, যা আজও নিঃশব্দে ফোটে লস অ্যাঞ্জেলসের অন্ধকারে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন