১৬শ–১৭শ শতকে বাংলার নবদ্বীপ, গৌড়, ও পরবর্তীকালে কলকাতা অঞ্চলে তন্ত্রমার্গীয় উপাসক সমাজের প্রভাবে কালীপূজার আচারবিধি সুসংগঠিত রূপ নেয়।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ও পুরাণে দেবী দুর্গার আরাধনা, তাঁর মর্ত্যে আগমন ও অসুর নিধনের কাহিনি সুপ্রাচীনকাল থেকেই গভীরভাবে লিপিবদ্ধ। কিন্তু কালীপূজার উল্লেখ তুলনামূলকভাবে পরবর্তী কালের সৃষ্টি। দেবী কালিকা—যাঁকে শাস্ত্রকারেরা শ্যামা, চামুণ্ডা, ভদ্রকালী, মহাকালী প্রভৃতি নামে অভিহিত করেছেন—তাঁর পূজার উৎপত্তি ও বিকাশের ধারাটি গবেষণার দিক থেকে এক জটিল ও বহুস্তরীয় ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া।
প্রাচীন বেদে কালী-উপাসনার প্রত্যক্ষ উল্লেখ পাওয়া যায় না। ‘ঋগ্বেদ’ বা ‘অথর্ববেদ’-এ ‘কালী’ শব্দটি কেবল ‘অন্ধকার’ বা ‘কালো’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, দেবীরূপে নয়। তবে ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণের’ ‘দেবীমাহাত্ম্য’ অংশে (প্রায় খ্রিস্টীয় ৫ম–৬ষ্ঠ শতক) প্রথমবার দেবী চামুণ্ডা বা কালী-রূপে দেবীর আবির্ভাবের ইঙ্গিত পাওয়া যায়—যেখানে তিনি অসুর রক্তবীজকে নিধন করেন। কিন্তু এখানেও কালী নিজে পূজার প্রধান কেন্দ্র নন; তিনি দুর্গার একটি উগ্র রূপমাত্র।
‘কালীপূজার স্বাধীন রূপে বিকাশ’ মধ্যযুগে, বিশেষত তন্ত্রসাধনার উত্থানের পর। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, গৌড় ও বঙ্গদেশে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে তান্ত্রিক শাক্তধর্ম বিকশিত হতে থাকে। ‘কালিকা পুরাণ’, ‘তন্ত্রসার’, ‘মহানির্বাণ তন্ত্র’, ‘কুলার্ণব তন্ত্র’ প্রভৃতি শাস্ত্রে কালীকে মহাশক্তির সর্বোচ্চ প্রতিমূর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়। এই সময়েই কালীপূজা ধীরে ধীরে দুর্গাপূজা থেকে পৃথক এক স্বতন্ত্র উৎসবে রূপ নেয়। ‘কালিকা পুরাণে’ (খ্রিস্টীয় ১০ম শতক) দেবী কালীকে বলা হয়েছে ‘ব্রহ্মরূপিণী’, ‘অখণ্ড তত্ত্বরূপা’, এবং তাঁকে প্রথাগত দেবতাদেরও ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে।
কালীপূজার জনপ্রিয় রূপটি মূলত বাংলার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতেই গড়ে ওঠে। ইতিহাসবিদ ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার ও ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৬শ–১৭শ শতকে বাংলার নবদ্বীপ, গৌড়, ও পরবর্তীকালে কলকাতা অঞ্চলে তন্ত্রমার্গীয় উপাসক সমাজের প্রভাবে কালীপূজার আচারবিধি সুসংগঠিত রূপ নেয়। জনশ্রুতি মতে, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ (১৫শ শতক) প্রথম কালীপূজার নিয়মিত আচারপ্রণালী স্থির করেন। তাঁর ‘তন্ত্রতত্ত্ব’ গ্রন্থে কালীপূজার নানা মন্ত্র, ন্যায়, ও তত্ত্বের বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে।
তবে অনেক গবেষক কালীপূজার মূল উৎস খুঁজে পান প্রাচীন ‘তিব্বতি বৌদ্ধ তন্ত্রসাধনায়’। বিশেষত মহাযান ও বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে ‘দাক্ষিণ্যকালী’ বা ‘দাকিনী কালী’ নামে এক ভয়ঙ্করী নারীশক্তির উপাসনা প্রচলিত ছিল। তিব্বতের বৌদ্ধ যোগিনীদের (যাঁদের ‘ডাকিনি’ বলা হয়) সাধনায় নারীত্ব ও শক্তি একইসঙ্গে জ্ঞানের প্রতীক। ‘হেজেল কনওয়ে’ এবং ‘ডেভিড ক্নোফ’ প্রমুখ আধুনিক গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে, বঙ্গ ও নেপাল অঞ্চলে বৌদ্ধ তন্ত্রসাধনা থেকে হিন্দু তন্ত্রের অনেক আচার ধার নেওয়া হয়। ‘কালী’ নাম ও তাঁর উগ্র, মৃতদেহভূষিত, শ্মশানবিহারী রূপ সেই বৌদ্ধ তান্ত্রিক ‘দাক্ষিণী কালী’ ধারণারই হিন্দু শাক্তরূপে বিবর্তন।
এই সংমিশ্রণ প্রক্রিয়া সম্ভবত পাল ও সেন আমলে (৮ম–১২শ শতক) ঘটে, যখন বৌদ্ধ ও হিন্দু তন্ত্র পরস্পরের প্রভাবে মিশে যায়। তাই কালীপূজার আচার—যেমন নিশিপূজা, শ্মশানসাধনা, পঞ্চমকার (মদ্য, মাংস, মাছ, মৈথুন, মুদ্রা)—সবই সেই তিব্বতি-বজ্রযানী প্রথার ছায়া বহন করে।
কালীপূজার সামাজিক উৎসব হিসেবে বিস্তার ঘটে ১৮শ শতকে, বিশেষ করে শোভাবাজার রাজবাড়ি, রাণী রাসমণি ও ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রভাবে। কলকাতার রাণী রাসমণি ১৮৫৬ সালে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করলে কালীপূজা সর্বজনীন মর্যাদা পায়। এরপর ধীরে ধীরে দীপাবলির সঙ্গে কালীপূজা একীভূত হয়ে পড়ে।
অতএব, দেবী দুর্গার আরাধনা যেখানে প্রাচীন বৈদিক যুগ পর্যন্ত প্রসারিত, সেখানে কালীপূজার ঐতিহ্য তুলনামূলকভাবে মধ্যযুগীয় তান্ত্রিক ও বৌদ্ধ প্রভাবের মিশ্রণে উদ্ভূত। কালী আজও যেমন শক্তির, প্রতিবাদের ও মুক্তির প্রতীক—তেমনি তিনি ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতির এক অনন্য সংযোগবিন্দু, যেখানে হিন্দু ও বৌদ্ধ তন্ত্র এক সুতোয় বাঁধা হয়ে রয়েছে।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ও পুরাণে দেবী দুর্গার আরাধনা, তাঁর মর্ত্যে আগমন ও অসুর নিধনের কাহিনি সুপ্রাচীনকাল থেকেই গভীরভাবে লিপিবদ্ধ। কিন্তু কালীপূজার উল্লেখ তুলনামূলকভাবে পরবর্তী কালের সৃষ্টি। দেবী কালিকা—যাঁকে শাস্ত্রকারেরা শ্যামা, চামুণ্ডা, ভদ্রকালী, মহাকালী প্রভৃতি নামে অভিহিত করেছেন—তাঁর পূজার উৎপত্তি ও বিকাশের ধারাটি গবেষণার দিক থেকে এক জটিল ও বহুস্তরীয় ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া।
প্রাচীন বেদে কালী-উপাসনার প্রত্যক্ষ উল্লেখ পাওয়া যায় না। ‘ঋগ্বেদ’ বা ‘অথর্ববেদ’-এ ‘কালী’ শব্দটি কেবল ‘অন্ধকার’ বা ‘কালো’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, দেবীরূপে নয়। তবে ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণের’ ‘দেবীমাহাত্ম্য’ অংশে (প্রায় খ্রিস্টীয় ৫ম–৬ষ্ঠ শতক) প্রথমবার দেবী চামুণ্ডা বা কালী-রূপে দেবীর আবির্ভাবের ইঙ্গিত পাওয়া যায়—যেখানে তিনি অসুর রক্তবীজকে নিধন করেন। কিন্তু এখানেও কালী নিজে পূজার প্রধান কেন্দ্র নন; তিনি দুর্গার একটি উগ্র রূপমাত্র।
‘কালীপূজার স্বাধীন রূপে বিকাশ’ মধ্যযুগে, বিশেষত তন্ত্রসাধনার উত্থানের পর। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, গৌড় ও বঙ্গদেশে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে তান্ত্রিক শাক্তধর্ম বিকশিত হতে থাকে। ‘কালিকা পুরাণ’, ‘তন্ত্রসার’, ‘মহানির্বাণ তন্ত্র’, ‘কুলার্ণব তন্ত্র’ প্রভৃতি শাস্ত্রে কালীকে মহাশক্তির সর্বোচ্চ প্রতিমূর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়। এই সময়েই কালীপূজা ধীরে ধীরে দুর্গাপূজা থেকে পৃথক এক স্বতন্ত্র উৎসবে রূপ নেয়। ‘কালিকা পুরাণে’ (খ্রিস্টীয় ১০ম শতক) দেবী কালীকে বলা হয়েছে ‘ব্রহ্মরূপিণী’, ‘অখণ্ড তত্ত্বরূপা’, এবং তাঁকে প্রথাগত দেবতাদেরও ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে।
কালীপূজার জনপ্রিয় রূপটি মূলত বাংলার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতেই গড়ে ওঠে। ইতিহাসবিদ ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার ও ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৬শ–১৭শ শতকে বাংলার নবদ্বীপ, গৌড়, ও পরবর্তীকালে কলকাতা অঞ্চলে তন্ত্রমার্গীয় উপাসক সমাজের প্রভাবে কালীপূজার আচারবিধি সুসংগঠিত রূপ নেয়। জনশ্রুতি মতে, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ (১৫শ শতক) প্রথম কালীপূজার নিয়মিত আচারপ্রণালী স্থির করেন। তাঁর ‘তন্ত্রতত্ত্ব’ গ্রন্থে কালীপূজার নানা মন্ত্র, ন্যায়, ও তত্ত্বের বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে।
তবে অনেক গবেষক কালীপূজার মূল উৎস খুঁজে পান প্রাচীন ‘তিব্বতি বৌদ্ধ তন্ত্রসাধনায়’। বিশেষত মহাযান ও বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে ‘দাক্ষিণ্যকালী’ বা ‘দাকিনী কালী’ নামে এক ভয়ঙ্করী নারীশক্তির উপাসনা প্রচলিত ছিল। তিব্বতের বৌদ্ধ যোগিনীদের (যাঁদের ‘ডাকিনি’ বলা হয়) সাধনায় নারীত্ব ও শক্তি একইসঙ্গে জ্ঞানের প্রতীক। ‘হেজেল কনওয়ে’ এবং ‘ডেভিড ক্নোফ’ প্রমুখ আধুনিক গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে, বঙ্গ ও নেপাল অঞ্চলে বৌদ্ধ তন্ত্রসাধনা থেকে হিন্দু তন্ত্রের অনেক আচার ধার নেওয়া হয়। ‘কালী’ নাম ও তাঁর উগ্র, মৃতদেহভূষিত, শ্মশানবিহারী রূপ সেই বৌদ্ধ তান্ত্রিক ‘দাক্ষিণী কালী’ ধারণারই হিন্দু শাক্তরূপে বিবর্তন।
এই সংমিশ্রণ প্রক্রিয়া সম্ভবত পাল ও সেন আমলে (৮ম–১২শ শতক) ঘটে, যখন বৌদ্ধ ও হিন্দু তন্ত্র পরস্পরের প্রভাবে মিশে যায়। তাই কালীপূজার আচার—যেমন নিশিপূজা, শ্মশানসাধনা, পঞ্চমকার (মদ্য, মাংস, মাছ, মৈথুন, মুদ্রা)—সবই সেই তিব্বতি-বজ্রযানী প্রথার ছায়া বহন করে।
কালীপূজার সামাজিক উৎসব হিসেবে বিস্তার ঘটে ১৮শ শতকে, বিশেষ করে শোভাবাজার রাজবাড়ি, রাণী রাসমণি ও ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রভাবে। কলকাতার রাণী রাসমণি ১৮৫৬ সালে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করলে কালীপূজা সর্বজনীন মর্যাদা পায়। এরপর ধীরে ধীরে দীপাবলির সঙ্গে কালীপূজা একীভূত হয়ে পড়ে।
অতএব, দেবী দুর্গার আরাধনা যেখানে প্রাচীন বৈদিক যুগ পর্যন্ত প্রসারিত, সেখানে কালীপূজার ঐতিহ্য তুলনামূলকভাবে মধ্যযুগীয় তান্ত্রিক ও বৌদ্ধ প্রভাবের মিশ্রণে উদ্ভূত। কালী আজও যেমন শক্তির, প্রতিবাদের ও মুক্তির প্রতীক—তেমনি তিনি ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতির এক অনন্য সংযোগবিন্দু, যেখানে হিন্দু ও বৌদ্ধ তন্ত্র এক সুতোয় বাঁধা হয়ে রয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন