মানুষের অব্যাহত হস্তক্ষেপ এই বনভূমির অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রাকৃতিক ব্যবস্থা আমাজন রেইনফরেস্ট আজ ক্রমাগত রূপান্তরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই বনভূমি শুধু একটি ভৌগোলিক সীমানা নয়, বরং পৃথিবীর জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের এক অপরিহার্য স্তম্ভ। লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনে গড়ে ওঠা এই ইকোসিস্টেম মানব সভ্যতার কাছে অক্সিজেনের আধার, মিঠা জলের ভাণ্ডার এবং জীববৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য হিসেবে কাজ করে এসেছে। তবু সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানীরা যে তথ্য তুলে ধরছেন তা উদ্বেগজনক। বন উজাড়, কৃষি সম্প্রসারণ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, খরা ও অগ্নিকাণ্ড, প্রজাতির বিলুপ্তি—সব মিলিয়ে আমাজন এখন এমন এক সংকটময় মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সামান্য অসতর্কতা গোটা বনভূমিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
আমাজনের গুরুত্ব বোঝার জন্য প্রথমেই বুঝতে হবে এর ভৌগোলিক ও পরিবেশগত পরিসর। প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই রেইনফরেস্টে রয়েছে প্রায় ৩৯০ বিলিয়ন গাছ, অন্তর্ভুক্ত প্রায় ১৬,০০০ ভিন্ন প্রজাতি। পৃথিবীর মোট বৃষ্টিঅরণ্যের প্রায় ৬০ শতাংশই এখানে, এবং এখান থেকেই উৎপন্ন হয় পৃথিবীর প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অক্সিজেন। পাশাপাশি, আমাজন নদী ও তার অসংখ্য শাখা পৃথিবীর মোট মিঠা জলের এক-পঞ্চমাংশ ধারণ করে। এক কথায়, এই অঞ্চল পৃথিবীর পরিবেশ ব্যবস্থার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, এর ক্ষতি মানে পুরো গ্রহের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া।
তবে মানুষের অব্যাহত হস্তক্ষেপ এই বনভূমির অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে শুরু হওয়া দ্রুত শিল্পায়ন ও কৃষির সম্প্রসারণের ফলে আমাজনের প্রায় ১৭ শতাংশ বনভূমি ইতিমধ্যেই কেটে ফেলা হয়েছে। প্রধানত ব্রাজিলেই এই ধ্বংসযজ্ঞ বেশি, যেখানে গবাদি পশুর চারণভূমি এবং সয়াবিন চাষের জন্য বিপুল পরিমাণ জমি উজাড় করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, যদি বন ধ্বংসের হার ২০ থেকে ২৫ শতাংশে পৌঁছায়, তবে আমাজন এক “টিপিং পয়েন্ট”-এ পৌঁছাবে, যেখানে এটি আর আগের মতো বৃষ্টিঅরণ্য থাকবে না, বরং ধীরে ধীরে সাভানার মতো শুষ্ক তৃণভূমিতে পরিণত হবে। এই পরিবর্তন কেবল স্থানীয় নয়, বৈশ্বিক জলবায়ুর জন্যও ভয়াবহ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমাজনে ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান। নাসা ও আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের তথ্য বলছে, গত অর্ধশতকে আমাজন অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা প্রায় এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। শতকের শেষে এই বৃদ্ধির হার চার ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি সরাসরি প্রভাব ফেলছে বৃষ্টিপাত ও খরার উপর। দীর্ঘায়িত শুষ্ক মৌসুম, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, এবং পুনঃপুন খরা বনভূমির জন্য মারাত্মক হয়ে উঠছে। আমাজন বনের স্বাভাবিক জলচক্রে প্রতিদিন কোটি কোটি টন জলীয়বাষ্প বায়ুমণ্ডলে ওঠে, যা দক্ষিণ আমেরিকার বৃষ্টিপাতের প্রধান উৎস। কিন্তু এই চক্রে ব্যাঘাত ঘটলে কৃষি, বনজ প্রাণী, এমনকি শহুরে জনজীবনও বিপর্যস্ত হবে। এ কারণে বিজ্ঞানীরা একে “উড়ন্ত নদী” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এর পাশাপাশি বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি। আগে প্রাকৃতিকভাবে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ছিল তুলনামূলক কম, কিন্তু আজ তীব্র খরা ও মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এতে বিপুল সংখ্যক গাছ নষ্ট হচ্ছে এবং সেইসঙ্গে বায়ুমণ্ডলে জমা হচ্ছে বিপুল কার্বন ডাই-অক্সাইড। বৈজ্ঞানিক গবেষণা এখন দেখাচ্ছে, আমাজনের কিছু অংশ আর কার্বন শোষণকারী সিঙ্ক নয়, বরং উল্টে কার্বন নির্গমনকারী সোর্সে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ বনভূমি যতটা কার্বন ধরে রাখছে তার চেয়ে বেশি বাতাসে ছেড়ে দিচ্ছে। পৃথিবীর উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের জন্য এটি এক ভয়াবহ সংকেত, কারণ যদি পুরো আমাজন এভাবে আচরণ শুরু করে তবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।
বনের পরিবর্তন সরাসরি আঘাত হেনেছে জীববৈচিত্র্যে। আমাজন পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। এখানে ২৫ লক্ষেরও বেশি কীটপতঙ্গ প্রজাতি, দুই হাজারের বেশি মাছ, এক হাজার তিনশোর বেশি পাখি, চার শতাধিক স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং কয়েক হাজার উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে। কিন্তু আবাসস্থল হারানো, বন উজাড় ও জলবায়ুর অস্থিরতা এই প্রজাতিগুলিকে ক্রমশ বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জাগুয়ার, গোলাপি নদী ডলফিন, বিরল প্রজাতির বানর, নানা রঙের ম্যাকাও তোতা পাখি—সবাই আজ সংকটাপন্ন। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, আগামী কয়েক দশকে আমাজনের অন্তত ১০ থেকে ২০ শতাংশ প্রজাতি হারিয়ে যেতে পারে।
এই পরিবর্তনের সামাজিক দিকও সমান গুরুত্বপূর্ণ। শত শত বছর ধরে আমাজনের ভেতরে বসবাস করছে প্রায় ৩৫০টি আদিবাসী গোষ্ঠী। তাদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার সবকিছুই এই বনভূমির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বন ধ্বংস হলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, আদিবাসী সম্প্রদায় বন রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে, কারণ তারা প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখে। কিন্তু বহিরাগত স্বার্থগোষ্ঠীর চাপ ও ভূমি দখলের কারণে তাদেরও জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।
সমাধানের পথ নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহু গবেষণা করেছেন। বন উজাড় বন্ধে শক্ত আইন প্রণয়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। কেবল জাতীয় পর্যায়ে নয়, বৈশ্বিক স্তরেও কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি এখানেই নিহিত। পাশাপাশি পুনঃবনায়ন ও পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত বনভূমি আবার জীবিত করে তোলা সম্ভব। গবেষণা দেখাচ্ছে, যদি সময়মতো উদ্যোগ নেওয়া যায় তবে আমাজনের অনেক অংশ আবার তার প্রাকৃতিক রূপ ফিরে পেতে পারে।
আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তিও এই লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্যাটেলাইট ডেটা, রিমোট সেন্সিং, ড্রোন প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বন ধ্বংসের প্রতিটি স্তর নিরীক্ষণ করা হচ্ছে। নাসা, ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি ও ব্রাজিলের গবেষণা সংস্থা একযোগে কাজ করছে যাতে বন উজাড় কোথায় কত দ্রুত ঘটছে তা শনাক্ত করা যায় এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এই প্রযুক্তি শুধু বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার জন্য নয়, ভবিষ্যতের ঝুঁকি পূর্বাভাস দিতেও সহায়ক।
আজ আমাজনের পরিবর্তন মানবজাতির কাছে এক কঠিন প্রশ্ন রেখে গেছে। আমরা কি এই মহাবনকে রক্ষা করতে পারব, নাকি অদূর ভবিষ্যতে এটিকে হারিয়ে ফেলব? উত্তর সহজ নয়, কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক স্বার্থ, রাজনৈতিক টানাপড়েন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। তবু বিজ্ঞান পরিষ্কার ভাষায় সতর্ক করেছে—যদি এখনই পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে আগামী একশো বছরের মধ্যে আমাজন সবুজ বৃষ্টিঅরণ্য থেকে পরিণত হবে এক শুষ্ক তৃণভূমিতে, যা পৃথিবীর জলবায়ু, প্রজাতির অস্তিত্ব এবং মানব সভ্যতার ভবিষ্যতের জন্য এক অপ্রতিরোধ্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন