পৃথিবীর মেরুর অবস্থান বদল: বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ

তিনটি উপগ্রহ একসঙ্গে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের অতি সূক্ষ্ম মানচিত্র তৈরি করছে।

পৃথিবীর মেরুর অবস্থান বদল: বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ

বরফে মোড়া উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু নিয়ে আমাদের কল্পনা বহু পুরোনো। রূপকথা, অভিযাত্রার কাহিনি কিংবা স্কুলের ভূগোল বই—সবখানেই মেরু অঞ্চল রহস্যময় স্থান হিসেবে উঠে এসেছে। আমরা ছোটবেলা থেকে শিখেছি পৃথিবীর দুটি ভৌগোলিক মেরু আছে, যেগুলো স্থির। কিন্তু পৃথিবীর আরেক জোড়া মেরুও আছে—চৌম্বকীয় উত্তর ও দক্ষিণ মেরু—যেগুলো কখনও স্থির নয়, বরং অবিরাম পরিবর্তিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, উত্তর চৌম্বক মেরু এখন প্রতি বছর প্রায় ৪৫ কিলোমিটার গতিতে সাইবেরিয়ার দিকে এগিয়ে চলেছে, যা গত শতাব্দীর শুরুর তুলনায় তিনগুণ বেশি দ্রুত। এই পরিবর্তন কেবল ভূতত্ত্বের রহস্য নয়, মানবসভ্যতার প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাত্রার উপরও গভীর প্রভাব ফেলতে চলেছে।

পৃথিবীর ভেতরে বিশাল এক অগ্নিগর্ভ অংশ লুকিয়ে আছে। কেন্দ্র ভাগ দুটি স্তরে বিভক্ত—ভেতরের কঠিন কেন্দ্র আর বাইরের তরল কেন্দ্র। তরল কেন্দ্র মূলত গলিত লোহা ও নিকেল দিয়ে গঠিত। এই তরল ধাতু ক্রমাগত সঞ্চালিত হয় এবং পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে মিলে এক ধরণের জটিল বৈদ্যুতিক প্রবাহ সৃষ্টি করে। সেই প্রবাহ থেকে উৎপন্ন হয় এক মহাশক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র, যাকে বলা হয় জিওডাইনামো। এই চৌম্বকক্ষেত্র পৃথিবীর চারপাশে বিস্তৃত হয়ে সৌরঝড় ও কসমিক রশ্মি থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। সূর্য থেকে আসা উচ্চশক্তির চার্জযুক্ত কণা যদি সরাসরি বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করত, তাহলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ত।

চৌম্বকক্ষেত্র যে স্থায়ী নয়, তার প্রমাণ বহু আগেই বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন। উনিশ শতকের গোড়ায় আবিষ্কৃত হয়েছিল উত্তর চৌম্বক মেরুর অবস্থান। তখন থেকেই নাবিকরা লক্ষ্য করছিলেন যে চৌম্বক সূঁচ ঠিক উত্তর দিকে নয়, সামান্য ভিন্ন দিকে ইঙ্গিত করছে। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিজ্ঞানীরা সুনিশ্চিত হন যে উত্তর মেরু ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। তখন প্রতি বছর এর গতিবেগ ছিল প্রায় ১৫ কিলোমিটার। কিন্তু ১৯৯০–এর দশকের পর হঠাৎ করে এই গতি তীব্র হয়। আজ তা প্রায় ৪৫ কিলোমিটার প্রতি বছর, এবং দিক সোজা সাইবেরিয়ার দিকে। এই দ্রুত পরিবর্তন বৈজ্ঞানিক মহলে এক নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

পৃথিবীর ইতিহাসে চৌম্বক মেরুর অবস্থান বদল একাধিকবার ঘটেছে। কেবল স্থানান্তর নয়, অনেক সময় পুরো চৌম্বকক্ষেত্র উল্টে যায়। অর্থাৎ উত্তর মেরু দক্ষিণে আর দক্ষিণ মেরু উত্তরে চলে আসে। ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ বলছে, গত সাত কোটি দশ লাখ বছরে এমন উলটফের ঘটেছে অন্তত ১৭১ বার। শেষবার এই ঘটনা ঘটেছিল প্রায় সাত লক্ষ আশি হাজার বছর আগে। সেই ঘটনাকে বলা হয় ব্রুনহেস-মাতুয়ামা রিভার্সাল। সমুদ্রতলের লাভা ও শিলা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এসব প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। লাভা যখন ঠান্ডা হয়, তখন তাতে থাকা লৌহকণা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে সমান্তরালভাবে স্থির হয়ে যায়। সেই লৌহকণাই অতীতের চৌম্বক দিক নির্দেশ করে।

চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তন কেবল প্রাকৃতিক কারণে নয়, সৌরঝড়ের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। সূর্যের বিস্ফোরণ থেকে নির্গত চার্জযুক্ত কণা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রকে অস্থির করে তোলে। এর ফলে চৌম্বক ঝড় সৃষ্টি হয়। এই ঝড়ে স্যাটেলাইটের যন্ত্রপাতি বিকল হতে পারে, বিমানের নেভিগেশন গোলমাল করতে পারে, এমনকি বিদ্যুৎ গ্রিডে ভয়াবহ বিভ্রাট ঘটতে পারে। ইতিমধ্যেই দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার মাঝে এক বিশেষ অঞ্চল, যা সাউথ আটলান্টিক অ্যানোমালি নামে পরিচিত, সেখানে চৌম্বকক্ষেত্রের শক্তি মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। গবেষকেরা মনে করছেন, এই দুর্বলতাই ভবিষ্যতের এক নতুন মেরুবদলের পূর্বাভাস হতে পারে।

চৌম্বকক্ষেত্র ও মেরুর নড়াচড়া বোঝার জন্য বর্তমানে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার হলো ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার সোয়ার্ম স্যাটেলাইট মিশন। তিনটি উপগ্রহ একসঙ্গে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের অতি সূক্ষ্ম মানচিত্র তৈরি করছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক ভূচৌম্বকীয় রেফারেন্স ফিল্ডের সর্বশেষ সংস্করণ। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে উত্তর ও দক্ষিণ চৌম্বক মেরু সমান্তরাল নয়, বরং অনেকটাই ভিন্ন। উত্তর মেরু বর্তমানে প্রায় ৮৪ ডিগ্রি চৌম্বক অক্ষাংশ ও ১৬৯ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে অবস্থান করছে, আর দক্ষিণ মেরু রয়েছে মাইনাস ৭৪ ডিগ্রি অক্ষাংশ ও ১৯ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে।

এই পরিবর্তন মানবসভ্যতার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা কল্পনা করাই যায়। আজকের পৃথিবী পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর। বিমান চালনা, নৌচালনা, গাড়ির জিপিএস, মোবাইল নেটওয়ার্ক, ব্যাংকিং লেনদেন—সব কিছুই স্যাটেলাইট নির্ভর নেভিগেশনের উপর দাঁড়িয়ে আছে। চৌম্বকক্ষেত্রের দ্রুত পরিবর্তন হলে নেভিগেশন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়তে পারে। গুগল ম্যাপের মতো সাধারণ অ্যাপ্লিকেশনেও বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে। আরও ভয়াবহ হলো মহাকাশ গবেষণা। যদি পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র দুর্বল হয়ে যায়, তবে কসমিক রশ্মি সরাসরি উপগ্রহে আঘাত হেনে সেটিকে অকেজো করে দিতে পারে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ধসে পড়লে বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে সামরিক প্রতিরক্ষা—সবই মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হবে।

তবে এই পরিবর্তন যে মানবসভ্যতার সমাপ্তি ঘটাবে, এমনটা নয়। ভূতাত্ত্বিক রেকর্ড বলছে, অতীতে মেরুবদল হওয়ার পরও জীবজগৎ টিকে গেছে। কিন্তু তখন মানুষের সভ্যতা ছিল না, প্রযুক্তি ছিল না। আজকের পৃথিবী সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফলে এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমাদেরকে প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি নিতে হবে। নেভিগেশন ব্যবস্থা আপডেট করতে হবে, স্যাটেলাইটকে সুরক্ষিত করতে হবে, বিদ্যুৎ গ্রিডকে আরও স্থিতিশীল করতে হবে।

ভবিষ্যতে কখন আবার মেরুবদল ঘটবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটি কয়েক হাজার বছরের মধ্যে ঘটতে পারে, আবার হয়তো আরও দেরি হবে। তবে লক্ষণ বলছে পৃথিবী এখন একটি পরিবর্তনশীল পর্যায়ে রয়েছে। সাউথ আটলান্টিক অ্যানোমালির দুর্বলতা এবং উত্তর মেরুর দ্রুত সরে যাওয়া হয়তো সেই বড় ঘটনারই ইঙ্গিত।

এই পরিবর্তনকে আমরা আতঙ্ক হিসেবে নয়, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের নতুন দিগন্ত হিসেবে দেখতে পারি। মেরুর নড়াচড়া আমাদের শেখায়, পৃথিবী একটি জীবন্ত গ্রহ, যার ভেতরে অবিরাম গতি আর শক্তির খেলা চলছে। সেই খেলা কখনও শান্ত, কখনও তীব্র। বিজ্ঞানীরা সোয়ার্মের মতো মিশনের মাধ্যমে এই খেলার নিয়ম বোঝার চেষ্টা করছেন। আজ হয়তো আমরা সব প্রশ্নের উত্তর জানি না, কিন্তু গবেষণার অগ্রগতির ফলে একদিন হয়তো নিশ্চিতভাবে বলা যাবে, কখন পৃথিবীর মেরু আবার উল্টে যাবে, আর মানবসভ্যতা সেই পরিস্থিতিতে কীভাবে টিকে থাকবে।

চৌম্বক মেরুর এই রহস্যময় যাত্রা কেবল বিজ্ঞানীদের কাছে নয়, আমাদের সবার কাছেই এক বিশাল বিস্ময়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা যে গ্রহে বাস করছি, সেটি কখনও স্থির নয়। বরং অবিরাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই পৃথিবী তার জীবনচক্র বজায় রাখে। আর সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়েই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মিত হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন