আলকাপ: বাংলার লোকায়ত গীতিনাট্যের ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

লোকসংস্কৃতি মরে না, কেবল রূপ পাল্টায়। আলকাপও সেই রূপান্তরের পথে। রজত

আলকাপ: বাংলার লোকায়ত গীতিনাট্যের ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

বাংলার লোকসংস্কৃতির ভাণ্ডার এতই বিস্তৃত যে তার প্রতিটি শাখা নিয়ে আলাদা আলাদা গ্রন্থ রচনা করা যায়। এই বিশাল ভাণ্ডারের এক বিশেষ শাখা হলো আলকাপ, যা মূলত গীতিনাট্য, নৃত্য, কৌতুক ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক লোকায়ত শিল্পরূপ। মুর্শিদাবাদ, মালদা, বীরভূম, নদীয়া এবং ঝাড়খণ্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চলেই আলকাপ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। একালে সিনেমা, টেলিভিশন ও ডিজিটাল মাধ্যমের দাপটে এর অস্তিত্ব টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে। তবে তার ঐতিহাসিক মূল্য ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য আজও অক্ষুণ্ণ।

আলকাপের শিকড় ও নামের তাৎপর্য

আলকাপের উৎপত্তি নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। কেউ বলেন, ‘আল’ মানে আনন্দ, আর ‘কাপ’ মানে রঙ্গরস বা ব্যঙ্গ। আবার কেউ কেউ মত দেন, ‘আল’ শব্দটি এসেছে দল বা সমষ্টি বোঝাতে, আর ‘কাপ’ এসেছে সাজপোশাক থেকে। এই ভিন্ন মত থাকলেও একটি বিষয় স্পষ্ট—আলকাপ মূলত সমষ্টিগত গীতিনাট্য, যেখানে অভিনয়, সঙ্গীত, নৃত্য ও ব্যঙ্গ একসঙ্গে মিশে যায়।

ইতিহাসবিদদের মতে, আঠারো শতকের শেষ ও উনিশ শতকের শুরুতে মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে আলকাপ বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নবাবি আমলের সামাজিক বিনোদন, জমিদার প্রথার আড্ডা, এবং গ্রামীণ মেলার পরিবেশ এই শিল্পের বিকাশে সহায়ক হয়েছিল।

পরিবেশনা কাঠামো ও শিল্পরীতি

আলকাপের দল সাধারণত ১২-১৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে থাকেন—

গাইনের বা সর্দার: যিনি কাহিনি বলেন, গান গেয়ে দল পরিচালনা করেন।
ছোকরা: পুরুষ শিল্পী, যারা নারী সেজে অভিনয় করেন।
বাদকদল: ঢোল, করতাল, মন্দিরা, বাঁশি, হারমোনিয়াম প্রভৃতি বাজান।

আলকাপের দুটি প্রধান অংশ হলো—‘কাপ’ এবং ‘আল’। ‘কাপ’-এ থাকে কাহিনি, অভিনয়, নাচ ও গান। আর ‘আল’-এ থাকে সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতিকে ব্যঙ্গ করে রঙ্গরসাত্মক সংলাপ। এই দুইয়ের মিশ্রণে আলকাপ হয়ে ওঠে একই সঙ্গে বিনোদন ও সামাজিক মন্তব্যের শক্তিশালী মাধ্যম।

সমাজে আলকাপের ভূমিকা

আলকাপ কেবল শিল্প নয়, এটি ছিল সমাজ-সংস্কৃতির আয়না। কৃষকের দুঃখ, গ্রামীণ দ্বন্দ্ব, পারিবারিক টানাপোড়েন, কিংবা জমিদারের অত্যাচার—এসবই আলকাপের কাহিনিতে প্রতিফলিত হতো। গ্রামীণ মানুষরা একদিকে হাসত, অন্যদিকে নিজেদের সমস্যার প্রতিচ্ছবি চিনতে পারত।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও আলকাপের ভূমিকা ছিল লক্ষণীয়। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে অনেক আলকাপ দলে ব্রিটিশ বিরোধী বার্তা উঠে এসেছে। ফলে এটি কেবল বিনোদনের শিল্প নয়, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিবাদেরও বাহক ছিল।

নারীর অনুপস্থিতি ও আধুনিক পরিবর্তন

আলকাপের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পুরুষ শিল্পীদের নারীর ভূমিকায় অভিনয় করা। সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে প্রকৃত নারীর অংশগ্রহণ সম্ভব হয়নি। ফলে ‘চোকরা’-রাই শাড়ি-গয়না পরে নাচগান করে দর্শক মাতাত।

তবে একালে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। মুর্শিদাবাদ ও মালদার কিছু আলকাপ দলে এখন প্রকৃত নারীরাও অংশ নিচ্ছেন। এটি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের প্রতিফলন [মণ্ডল, ২০২১]।

একালের সঙ্কট ও রূপান্তর

আজকের দিনে আলকাপ নানা কারণে পিছিয়ে পড়ছে। প্রথমত, আধুনিক বিনোদন মাধ্যম যেমন সিনেমা, টিভি সিরিয়াল, ইউটিউব—এগুলির কাছে দীর্ঘ রাতভর চলা আলকাপের আবেদন কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, শিল্পীদের আর্থিক সঙ্কট এতটাই গভীর যে তরুণ প্রজন্ম আর এই শিল্পে আসতে চায় না। তৃতীয়ত, দর্শক টানতে অনেক দল সিনেমার গান, হিন্দি সংলাপ ইত্যাদি ঢুকিয়ে দিচ্ছে, যা মূল ঐতিহ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে ।

সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ

তবু আলকাপের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, লোকসংস্কৃতি উৎসবে আলকাপকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। সরকারও কিছু পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যেমন ইউটিউব ও ফেসবুক আলকাপকে নতুন করে দর্শকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।

লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ শ্যামলকান্তি ঘোষের মতে, “আলকাপকে বাঁচাতে হলে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। লোকগান, উপভাষা, ব্যঙ্গরস বজায় রেখেই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে”।

আলকাপ বাংলার লোকজীবনের এক অমূল্য সম্পদ। এটি গ্রামীণ সমাজের আনন্দ-বেদনা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, কৌতুক ও প্রতিবাদকে একসঙ্গে ধারণ করেছে। আজকের দিনে সংকটে পড়লেও এটি হারিয়ে যায়নি। বরং নতুন প্রজন্ম, গবেষক, ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের আগ্রহ থাকলে আলকাপ নতুন রূপে বাঁচতে পারে।

লোকসংস্কৃতি মরে না, কেবল রূপ পাল্টায়। আলকাপও সেই রূপান্তরের পথে। আগামী দিনে হয়তো এটি আগের মতো গ্রামীণ মেলায় ততটা জনপ্রিয় থাকবে না, কিন্তু উৎসব, গবেষণা ও ডিজিটাল মাধ্যমের মাধ্যমে তার স্মৃতি ও সত্তা টিকে থাকবে।

সূত্র তালিকা
১. সেন, দীনেশচন্দ্র (১৯২৫)। বাংলার লোকসাহিত্য। কলকাতা: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ।
২. বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিতকুমার (১৯৮১)। বাংলার নাট্যঐতিহ্য। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ।
৩. দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ (১৯৯৮)। লোকসংস্কৃতি ও বাংলার গ্রামীণ শিল্প। মুর্শিদাবাদ: গ্রামীণ গবেষণা কেন্দ্র।
৪. চক্রবর্তী, অরুণ (২০১৪)। আলকাপ: এক লোকনাট্যের ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব। কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং।
৫. বাংলা লোকসংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র (২০১৯)। বাংলার লোকনাট্য ও লোকায়ত শিল্প: একটি সমীক্ষা। কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর।
৬. মণ্ডল, কাকলি (২০২১)। “আলকাপে নারীর অংশগ্রহণ: একালের প্রেক্ষাপট।” লোকসংস্কৃতি গবেষণা পত্রিকা, খণ্ড ১৫।
৭. ঘোষ, শ্যামলকান্তি (২০২০)। “লোকনাট্যের আধুনিকীকরণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা।” সাংস্কৃতিক আলোচনার পত্রিকা, খণ্ড ৮।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন