বিহারের জমুই জেলায় মিলেছে ভারতের সবচেয়ে বড় সোনার ভাণ্ডার—২২২ মিলিয়ন টন আকরিক, ৩৭.৬ টন সোনা! অর্থনীতিতে সোনালি যুগের সম্ভাবনা জাগল।
পাটনা: বিহার—যে রাজ্য এতদিন ধরে চিরকাল দরিদ্রতা, বেকারত্ব, আর পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য খবরের শিরোনামে থেকেছে—সেই রাজ্যের মাটির নিচে এখন লুকিয়ে আছে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সোনার ভাণ্ডার!
ভূতত্ত্ব জরিপ দফতর (GSI)-এর ২০২২ সালের এক সমীক্ষায় প্রকাশ, বিহারের জমুই জেলায় পাওয়া গেছে প্রায় ২২২.৮৮ মিলিয়ন টন সোনাযুক্ত আকরিক, যার মধ্যে সোনার পরিমাণ ৩৭.৬ টন। হিসেব বলছে, ভারতের মোট সোনার মজুদের প্রায় ৪৪ শতাংশই বিহারে!
এমন তথ্য শুনে প্রথমে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু এখন রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সংস্থা—যেমন GSI ও NMDC (ন্যাশনাল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন)—একসঙ্গে এই অনুসন্ধান শুরু করতে চলেছে। রাজ্যের খনি ও ভূতত্ত্ব দফতরের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব হরজোত কৌর বামরাহ জানিয়েছেন, শীঘ্রই কেন্দ্রীয় সংস্থার সঙ্গে একটি MoU (সমঝোতা চুক্তি) সই হবে। তার পরেই শুরু হবে প্রাথমিক স্তরের (G3) অনুসন্ধান। কিছু এলাকায় আরও উন্নত স্তরের (G2) কাজও হবে।
কোথায় মিলল এই সোনা?
জমুই জেলার করমাটিয়া, ঝাঝা ও সোনো অঞ্চলে মাটি ও শিলার নিচে সোনার ইঙ্গিত পেয়েছে GSI। এই তিন জায়গায় শুরু হবে প্রথম দফার অনুসন্ধান। তবে এখনও পর্যন্ত খনন শুরু হয়নি, কারণ প্রকল্পটি এখন পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির পর্যায়ে।
কেন্দ্রীয় খনি মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী সংসদে জানিয়েছেন, ভারতের মোট ৫০১.৮৩ মিলিয়ন টন প্রাথমিক সোনার আকরিকের মধ্যে বিহারে রয়েছে ২২২.৮৮৫ মিলিয়ন টন, যাতে ৩৭.৬ টন সোনা আছে। অর্থাৎ, ভারতের প্রায় অর্ধেক সোনার ভাণ্ডার একাই বিহারের মাটিতে!
বিহারের অর্থনীতিতে সোনালি আশা
যদি অনুসন্ধান সফল হয় এবং খনন শুরু হয়, তাহলে বিহারের অর্থনীতিতে এক সোনালি অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে। রাজ্য সরকারের মতে, এই প্রকল্প থেকে তৈরি হবে হাজার হাজার কর্মসংস্থান, বাড়বে রাজস্ব, গড়ে উঠবে নতুন শিল্প।
একজন উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক বলেছেন, “এটি বিহারের জন্য সত্যিই গেম চেঞ্জার হতে পারে। একদিকে যেমন শিল্পায়ন ঘটবে, তেমনই রাজ্য অর্থনৈতিক দিক থেকেও অনেকটা এগোবে।”
ভারতের সোনার মানচিত্রে বিহারের উত্থান
এতদিন পর্যন্ত কর্ণাটকই ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় সোনা উৎপাদক রাজ্য—হুট্টি ও কোলার গোল্ড ফিল্ডস থেকেই আসে দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ সোনা। কিন্তু বিহারের এই আবিষ্কার দেশের সোনার মানচিত্রকেই পাল্টে দিতে পারে।
সোনার মজুদের দিক থেকে রাজস্থান রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে (২৫%), কর্ণাটক তৃতীয় (২১%), পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্রপ্রদেশ ৩ শতাংশ করে, আর ঝাড়খণ্ড ২ শতাংশে। বাকিটা ছড়িয়ে আছে ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, কেরল, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুতে।
কীভাবে আবিষ্কার হয়েছিল এই সোনার ভাণ্ডার?
২০২২ সালে GSI-এর এক সাধারণ ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র তৈরির সময় দক্ষিণ বিহারের পাহাড়ি অঞ্চলে সোনার উপস্থিতি ধরা পড়ে। পরবর্তী বিশ্লেষণে দেখা যায়, জমুই জেলার শিলা স্তরে প্রচুর পরিমাণে সোনাযুক্ত খনিজ রয়েছে।
নতুন নীতি অনুযায়ী এখন এমনকি G4 স্তরের অনুসন্ধানের ভিত্তিতেও খনি লিজের নিলাম ডাকা সম্ভব। ফলে এই প্রকল্প দ্রুত এগোবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চ্যালেঞ্জও কম নয়
তবে সব কিছুই এত সহজ নয়। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, সোনার খনন অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং প্রযুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়া। পরিবেশগত ছাড়পত্র, স্থানীয় মানুষের পুনর্বাসন, ও সঠিক রাজস্ব বণ্টন—সব কিছু নিখুঁতভাবে না হলে, এই প্রকল্প থমকে যেতে পারে।
তবুও বিহারের মানুষের মনে এখন নতুন আশা। যে রাজ্য এতদিন কেবল পরিযান ও বেকারত্বের জন্য পরিচিত ছিল, সেই রাজ্য একদিন ভারতের সোনার রাজধানী হয়ে উঠতে পারে—এটাই এখন তাদের স্বপ্ন।
ওবিচুয়ারি: দারিদ্র্যের মাটি ফুঁড়ে উঠছে বিহারের সোনালি স্বপ্ন
বিহার—যে রাজ্যের নাম শুনলেই এতদিন মনে আসত বেকারত্ব, অবকাঠামোর অভাব, আর ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের গল্প। কিন্তু জমুইয়ের মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এই সোনার খবর যেন রাজ্যের আত্মায় এক নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে।
এই আবিষ্কার কেবল খনিজ সম্পদের খবর নয়—এটি এক প্রতীক, যে রাজ্য দীর্ঘদিন অবহেলার অন্ধকারে ডুবে ছিল, সেখানেই এখন জেগে উঠছে নতুন আশার আলো। বিহারের এই সোনার খনি যদি সত্যি আকার নেয়, তাহলে এটি শুধু রাজ্যের অর্থনীতির নয়, আত্মসম্মানেরও পুনর্জন্ম ঘটাবে।
তবে সোনার চকচকে আলো যেন চোখ না ধাঁধিয়ে দেয়। প্রকৃতি, পরিবেশ, ও স্থানীয় মানুষের স্বার্থ রক্ষা করেই যদি এই সম্পদ ব্যবহার করা যায়, তবেই এই আবিষ্কার সত্যিই অর্থবহ হবে।
বিহারের মাটির নিচে আজ শুধু সোনা নয়, ঘুমিয়ে আছে সম্ভাবনা, আত্মবিশ্বাস, আর পুনর্জাগরণের প্রতিশ্রুতি—যা একদিন হয়তো এই রাজ্যকে দারিদ্র্যের অন্ধকার থেকে টেনে তুলবে আলোর দিকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন