দেশজুড়ে বার কাউন্সিলগুলিতে লিঙ্গ বৈষম্য: মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের দাবি, সুপ্রিম কোর্টের নোটিশ

মামলায় দাবি করা হয়েছে, সংবিধানের ১৪, ১৫, ১৬ ও ২১ ধারায় বর্ণিত সমতা ও প্রতিনিধিত্বের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজ্যজুড়ে বার কাউন্সিলগুলিতে এক-তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ করা হোক।

দেশজুড়ে বার কাউন্সিলগুলিতে লিঙ্গ বৈষম্য: মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের দাবি, সুপ্রিম কোর্টের নোটিশ
এআই কৃত ছবি

নয়াদিল্লি : আইন পেশায় এখন নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও বর্তমানে গোটা দেশে রাজ্য বার কাউন্সিলগুলিতে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে মাত্র ৯ জন মহিলা, যেখানে পুরুষ সদস্য সংখ্যা ৪৩২ — অর্থাৎ মোট প্রতিনিধিত্বের মাত্র ২.০৪ শতাংশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যগুলির বার কাউন্সিলগুলিতে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের দাবি সংক্রান্ত এক জনস্বার্থ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট শুক্রবার নোটিস জারি করল। তাদের ওক সপ্তাহের মধ্যে ই-মেলে বক্তব‌্য জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, এই চিত্রকে শীর্ষ আদালত নিজেই ‘চরম বৈষম্যের প্রতিফলন’ বলে অভিহিত করেছে।

এই মামলা দায়ের করেছেন আইনজীবী শেহলা চৌধুরী। পিটিশনটি প্রস্তুত করেছেন আইনজীবী মোহাম্মদ আনাস চৌধুরী ও আলিয়া জায়েদ এবং দাখিল করেছেন অ্যাডভোকেট-অন-রেকর্ড আনসার আহমদ চৌধুরী। মামলার শুনানি হয় বিচারপতি সুর্যকান্ত ও জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চে। পিটিশনারের পক্ষে আইনজীবী ড. চারু মথুর যুক্তি দেন যে, যদিও কিছু রাজ্য ইতিমধ্যেই মনোনয়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে, তবু সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিতে পারে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য পুনরায় মনোনয়নের সুযোগ খুলে দেওয়ার। তাঁর বক্তব্য, “নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে তিন দিনের জন্য হলেও মনোনয়ন প্রক্রিয়া পুনরায় খোলার নির্দেশ দিতে পারে আদালত।”

বেঞ্চ বিষয়টির গুরুত্ব স্বীকার করে সব রাজ্য বার কাউন্সিলকে ইমেলের মাধ্যমে এক সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে নির্দেশ দেয়। মামলায় দাবি করা হয়েছে, সংবিধানের ১৪, ১৫, ১৬ ও ২১ ধারায় বর্ণিত সমতা ও প্রতিনিধিত্বের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজ্যজুড়ে বার কাউন্সিলগুলিতে এক-তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ করা হোক।

পিটিশনে বলা হয়েছে, আইন পেশায় মহিলাদের অংশগ্রহণ গত কয়েক দশকে দ্রুত বেড়েছে, কিন্তু নেতৃত্ব পর্যায়ে তাঁদের উপস্থিতি এখনও নগণ্য। এই পরিস্থিতি পেশার অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রকে ক্ষুণ্ণ করছে। ‘বার অ্যান্ড বেঞ্চ’-এর জুলাই ২০২১-এর এক সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের সব রাজ্য বার কাউন্সিলে মোট ৪৪১ জন নির্বাচিত সদস্যের মধ্যে মাত্র ৯ জন মহিলা। ফলে নারীদের সমস্যা বা উদ্বেগ প্রায়ই অগ্রাহ্য হয়।

পিটিশনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের গবেষণা ও পরিকল্পনা কেন্দ্রের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, দেশের প্রায় পাঁচভাগের একভাগ জেলা আদালতে এখনও মহিলাদের জন্য আলাদা শৌচাগার নেই। এই ধরনের কাঠামোগত অবহেলার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে সিদ্ধান্তগ্রহণের স্তরে নারীদের অনুপস্থিতি।

নারীদের আইনপেশায় প্রবেশের ইতিহাসও আদালতের নজরে আনা হয়েছে। কর্নেলিয়া সোরাবজি ১৮৯২ সালে অক্সফোর্ড থেকে প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে সিভিল ল’ পরীক্ষা পাস করলেও ভারতে প্র্যাকটিসের অনুমতি পাননি। ১৯১৬ সালে কলকাতা হাইকোর্টও রেজিনা গুহার নাম অন্তর্ভুক্তির আবেদন খারিজ করেছিল। ১৯২৩ সালে Legal Practitioners (Women) Act কার্যকর হওয়ার পরেই মহিলারা আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিসের অধিকার পান। শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও নেতৃত্বের আসনে তাঁদের উপস্থিতি আজও অত্যন্ত সীমিত।

পিটিশনে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, Advocates Act, 1961-এর ৬(১)(ডি) ধারা অনুযায়ী বার কাউন্সিলগুলির দায়িত্ব আইনজীবীদের অধিকার ও সুবিধা সুরক্ষিত রাখা। তাই মহিলাদের বাস্তব সমস্যা ও পেশাগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাউন্সিলের গঠনেও লিঙ্গ-সমতার প্রতিফলন থাকা জরুরি।

আবেদনে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই কার্যকর হওয়া সংস্কারের দিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে— যেমন সংসদ ও বিধানসভায় মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের প্রস্তাব (নারী শক্তি বন্দন অধিনিয়ম, ১০৬তম সংশোধনী), পঞ্চায়েত ও পৌর সংস্থায় সংরক্ষণের বিধান (অনুচ্ছেদ ২৪৩ডি ও ২৪৩টি), এবং সমবায় সংস্থাগুলিতে নারীদের প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা (২৪৩জে(১))।

পিটিশনে সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব দৃষ্টান্তও উল্লেখ করা হয়েছে— ২০২৪ সালের ২ মে আদালত Supreme Court Bar Association-এর কার্যনির্বাহী কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছিল। শেহলা চৌধুরীর যুক্তি, একই নীতি অনুসারে দেশের সব রাজ্য বার কাউন্সিলেও নারীদের জন্য সংরক্ষণ কার্যকর করা উচিত। তাঁর বক্তব্যে বলা হয়েছে, “proportional representation শব্দবন্ধটি তখনই অর্থবহ হবে, যখন তা আইনজীবী সমাজের অন্তর্ভুক্তিহীন শ্রেণিগুলির, বিশেষ করে মহিলাদের, ন্যায্য অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করবে।”

এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের পরবর্তী শুনানি এক সপ্তাহ পরে নির্ধারিত হয়েছে, এবং আইনি মহলে ইতিমধ্যেই আলোড়ন পড়েছে— নারী আইনজীবীদের নেতৃত্বে অংশগ্রহণের পথ কি এবার সত্যিই খুলে যাচ্ছে?

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন