ভাঙছে ডমিনিক ল্যাপিয়রের স্বপ্ন, বন্ধ হতে চলেছে সুন্দরবনের ভাসমান হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা

‘City of Joy’–সহ ল্যাপিয়রের বেস্টসেলার বইগুলির রয়্যালটি বহু বছর ধরে সুন্দরবনের স্বাস্থ্য মিশনের মূল অর্থসংস্থান ছিল।

ভাঙছে ডমিনিক ল্যাপিয়রের স্বপ্ন, বন্ধ হতে চলেছে সুন্দরবনের ভাসমান হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা
সুন্দরবনের একটি অনুষ্ঠানে সাহিত্যিক ডমিনিক ল্যাপিয়র ও SHIS–এর ডিরেক্টর এম এ ওয়াহাব।

কলকাতা : বহু দশক ধরে সুন্দরবনের দুর্গম দ্বীপজুড়ে যে স্বাস্থ্যপরিকাঠামোর স্বপ্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাহিত্যিক ডমিনিক ল্যাপিয়র গড়ে তুলেছিলেন, তা এখন ভেঙে পড়ার মুখে। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে ‘সিটি অব জয় ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে পরিচালিত SHIS (সাউদার্ন হেলথ ইমপ্রুভমেন্ট সমিতি)-এর স্বাস্থ্য পরিষেবা। কারণ কেন্দ্র ও রাজ্য—উভয় পক্ষ থেকেই বিভিন্ন প্রকল্পের তহবিল বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ।

SHIS–এর ডিরেক্টর ও বিশিষ্ট সমাজসেবী এম এ ওয়াহাব জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক গত বছর থেকেই ডমিনিক ল্যাপিয়রের ‘সিটি অব জয় ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে তহবিল পাঠানো বন্ধ করেছে। এর জন‌্য কোনও নির্দিষ্ট কারণও জানানো হয়নি। বহু বছর ধরে এই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় SHIS পরিচালনা করত ভাসমান নৌকা-হাসপাতাল ও দ্বীপভিত্তিক ক্লিনিক, যেখানে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যপরিষেবা, চক্ষু চিকিৎসা, প্রতিবন্ধী পরিষেবা, নিউরো, কার্ডিয়াক ও অর্থোপেডিক চিকিৎসা, এমনকি আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের ব্যবস্থাও ছিল।

পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে রাজ্য সরকারের তহবিল বন্ধের সিদ্ধান্ত। সুন্দরবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রকল্পগুলির জন্য SHIS–কে যে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হত, সেটাও থেমে গিয়েছে। ফলে সংস্থা ছয়টি ভাসমান নৌকা-হাসপাতাল এবং সাতটি স্থলভিত্তিক হাসপাতাল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক হাজারের বেশি ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বেতন পাচ্ছেন না। ওয়াহাব জানাচ্ছেন, “শুধু সুন্দরবনের শিশুদের কথা ভেবে কিছু ডাক্তার-নার্স এখনও বিনা পারিশ্রমিকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু পরিকাঠামো ভেঙে পড়ছে। তহবিল ছাড়া পরিষেবা চালানো অসম্ভব।”

ভাঙছে ডমিনিক ল্যাপিয়রের স্বপ্ন, বন্ধ হতে চলেছে সুন্দরবনের ভাসমান হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা
নদীপথে ভ্রাম‌্যমান বোট-ক্লিনিক।

এই সংকট ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে উত্তরবঙ্গেও। SHIS চা-বাগানের শ্রমিকদের জন্য যে বিনামূল্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা চালাত, তাও তহবিলের অভাবে কয়েক মাস আগেই বন্ধ করতে হয়েছে।

২০২২ সালে প্রয়াত আন্তর্জাতিক খ‌্যাতিসম্পন্ন সাহিত্যিক ডমিনিক ল্যাপিয়র তাঁর জীবনের বড় অংশ ব্যয় করেছিলেন ভারতের মানবকল্যাণমূলক কাজে। তাঁর স্ত্রী ও সিটি অব জয় ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ডমিনিক কঁশোঁ-ল্যাপিয়র এই পরিস্থিতিকে ‘ব্যথার ও মর্মান্তিক’ বলে উল্লেখ করেছেন। ‘City of Joy’–সহ ল্যাপিয়রের বেস্টসেলার বইগুলির রয়্যালটি বহু বছর ধরে সুন্দরবনের স্বাস্থ্য মিশনের মূল অর্থসংস্থান ছিল। সেই টাকাতেই তৈরি হয়েছিল ভাসমান হাসপাতাল, যা দূরবর্তী নদীবেষ্টিত দ্বীপগুলিতে পৌঁছে দিত জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা।

SHIS ও ল্যাপিয়রের এই যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে গত কয়েক দশকে প্রায় ৯,০০০ অপুষ্ট শিশু, যারা কুষ্ঠ ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ছিল, তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন হয়েছে। ১,২০০টি গ্রামে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে টিবি। স্থাপন করা হয়েছে ৫৪১টি টিউবওয়েল, যাতে লবণাক্ত অঞ্চলে মিষ্টি পানির জোগান মেলে। মানবিক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ল্যাপিয়রকে ২০০৮ সালে পদ্মভূষণে ভূষিত করা হয়েছিল।

কিন্তু এখন তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই দীর্ঘ দিনের মানবিক উত্তরাধিকারই অনিশ্চয়তায়।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সদস্য এবং বিজেপি সাংসদ জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো জানিয়েছেন, তিনি তহবিল বন্ধের বিষয়ে কোনও তথ্য জানেন না। বলেন, “বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কাছে এলেই কেন্দ্রের কাছে পাঠানো হবে।” অন‌্যদিকে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, SISH ইতিমধ্যেই ডিসেম্বর থেকে কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে জানিয়েছে।

কেন্দ্র ও রাজ্য—দুই দিকের সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সুন্দরবনের ৫৪টি নদীবেষ্টিত দ্বীপে বহু দশকের পরিশ্রমে তৈরি স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখন টালমাটাল, এবং বিপদের মুখে পড়ছেন প্রায় ১৪–১৫ লক্ষ গ্রামবাসী।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন