ঠান্ডা যুদ্ধের সময় এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চিন এমন অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করেছিল।
দ্য হেগ : উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষের চেতনা, স্মৃতি, আচরণ বা উপলব্ধিকে সরাসরি লক্ষ্য করে আঘাত হানতে পারে এমন 'মস্তিষ্ক-নিয়ন্ত্রণকারী অস্ত্র' আর কেবল বিজ্ঞান কল্পকাহিনির বিষয় নয়—এমনই দাবি তুলেছেন ব্রিটেনের ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বিশিষ্ট গবেষক, মাইকেল ক্রাউলি ও ম্যালকম ড্যান্ডো। তাঁদের নতুন বই শিগগিরই প্রকাশ পেতে চলেছে, যেখানে গোটা বিশ্বকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। এই সপ্তাহেই তাঁরা দ্য হেগ-এ এক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বৈঠকে যোগ দিতে রওনা হচ্ছেন। যেখানে রাষ্ট্রপক্ষগুলির সামনে তুলে ধরা হবে— মানব মস্তিষ্কই যুদ্ধক্ষেত্রের নতুন সীমান্ত। সে কারণে নিউরোসায়েন্সকে অস্ত্র বানানোর চেষ্টার উপর তাত্ক্ষণিক আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
ক্রাউলি বলেন, “শুনতে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির মতো লাগলেও বিপদ হল, এটি দ্রুত বাস্তবে পরিণত হচ্ছে।” তাঁর মতে, স্নায়ুবিজ্ঞান, ফার্মাকোলজি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত অগ্রগতি মিলেমিশে এমন সম্ভাবনা তৈরি করেছে যা আগে অকল্পনীয় ছিল। জটিল রাসায়নিক বা প্রযুক্তিগত উপায়ে মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে লক্ষ্য করে কাউকে স্তব্ধ করা, বিভ্রান্ত করা, প্রভাবিত করা বা বাধ্য করা—সবই এখন আরও নিখুঁত ও সহজলভ্য হয়ে উঠছে।
বইটিতে রাষ্ট্র-সমর্থিত কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র-প্রভাবিত রাসায়নিক অস্ত্রের ভয়াবহ ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চিন এমন অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করেছিল যা মানুষকে দীর্ঘ সময়ের জন্য অচেতনতা, হ্যালুসিনেশন, বিভ্রান্তি, পক্ষাঘাত বা দিশেহারা অবস্থায় ফেলতে পারে। এ ধরনের অস্ত্র সবচেয়ে বড় আকারে ব্যবহার হয় ২০০২ সালে মস্কোর থিয়েটার অবরোধের সময়, যখন রুশ নিরাপত্তা বাহিনী ফেন্টানিল-জাতীয় রাসায়নিক ব্যবহার করে জঙ্গিদের দমন করে। যদিও অধিকাংশ পনবন্দিকে উদ্ধার করা হয়েছিল, তবু ১২০-র বেশি মানুষ রাসায়নিকের প্রভাবে মারা যান এবং অনেকে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির শিকার হন।
গবেষকদের দাবি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রযুক্তি আরও উন্নত, লক্ষ্যভেদী এবং ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে। ড্যান্ডোর কথায়, “যে জ্ঞান স্নায়বিক রোগ চিকিৎসায় কাজে লাগে, তা-ই ভবিষ্যতে মানুষের মস্তিষ্ককে বিভ্রান্ত করা, মতিগতি নিয়ন্ত্রণ করা বা কাউকে অজান্তে ব্যবহারযোগ্য এজেন্টে পরিণত করার জন্যও অপব্যবহার হতে পারে।”
তাঁরা সতর্ক করেছেন, এই হুমকি ‘বাস্তব এবং ক্রমবর্ধমান’ হলেও আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিগুলির বড় ফাঁকফোকর রয়েছে, যা এমন বিপজ্জনক প্রযুক্তিকে রোধ করতে অক্ষম। তাই কেমিক্যাল ওয়েপনস কনভেনশনের বাইরে একটি নতুন ‘সমন্বিত অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ কাঠামো’ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা বইটিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। এতে CNS-প্রভাবিত ও অক্ষমকারী রাসায়নিক নিয়ে আলাদা ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ, মনিটরিং ও সংজ্ঞা স্পষ্ট করার মতো নানা বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
এই সপ্তাহেই তাঁরা দ্য হেগ-এ কেমিক্যাল ওয়েপনস কনভেনশনের ৩০তম সেশন—কনফারেন্স অব দ্য স্টেটস পার্টিজ (CSP)-এ উপস্থিত থাকবেন, যেখানে তাঁদের বক্তব্য এই নতুন হুমকির দিকে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
ড্যান্ডোর মতে, “প্রতিক্রিয়াশীল নয়, আমাদের এখনই সক্রিয় ও অগ্রগামী শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।” আর ক্রাউলি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “এটি একটি সতর্কবার্তা—মানব মস্তিষ্কের পবিত্রতা ও বিজ্ঞানের সততা রক্ষা করতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন