৭ লক্ষ বছর পর জেগে উঠছে ইরানের আগ্নেয়গিরি

গবেষণায় জানা গিয়েছে, এই পরিবর্তন বৃষ্টিপাত বা ভূমিকম্পের কারণে নয়, বরং আগ্নেয়গিরির অন্তঃস্থলে প্রায় ১,৬০০ থেকে ২,০০০ ফুট গভীরে গ্যাস ও উষ্ণ তরলের চাপ বাড়ছে।

৭ লক্ষ বছর পর জেগে উঠছে ইরানের আগ্নেয়গিরি

৭ লক্ষ বছর ধরে শুপ্ত থাকা ইরানের তাফতান আগ্নেয়গিরি ফের জেগে উঠছে। দেশটির পূর্ব প্রান্তের প্রায় ১৩ হাজার ফুট উঁচু এই আগ্নেয়গিরি দীর্ঘদিন ধরেই নিষ্ক্রিয় বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে উপগ্রহচিত্রে দেখা যায়, আগ্নেয়গিরির চূড়াটি ধীরে ধীরে উঁচু হচ্ছে। টানা দশ মাসের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন ইঞ্চি উঁচু হয়েছে সেই চূড়া, এবং এরপর থেকে তা আগের অবস্থায় ফেরেনি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই উত্থান তাফতানকে আর মৃত আগ্নেয়গিরি বলা যায় না, বরং এটি ফের জেগে উঠতে পারে।

স্পেনের ইনস্টিটিউট অফ ন্যাচারাল প্রোডাক্টস অ্যান্ড অ্যাগ্রোবায়োলজির আগ্নেয়গিরি বিশেষজ্ঞ পাবলো গনসালেসের নেতৃত্বাধীন এক দল ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার সেনটিনেল-১ উপগ্রহের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই পরিবর্তন শনাক্ত করেছেন। তাঁদের গবেষণায় জানা গিয়েছে, এই পরিবর্তন বৃষ্টিপাত বা ভূমিকম্পের কারণে নয়, বরং আগ্নেয়গিরির অন্তঃস্থলে প্রায় ১,৬০০ থেকে ২,০০০ ফুট গভীরে গ্যাস ও উষ্ণ তরলের চাপ বাড়ছে। সম্ভবত অল্প পরিমাণ ম্যাগমাও উপরের দিকে সরে এসেছে। গনসালেস বলেন, ‘‘এই চাপ একসময় না একসময় বেরোবে, হয় বিস্ফোরণের মাধ্যমে, নয়তো নীরবে।’’ তবে আপাতত কোনও আসন্ন অগ্ন্যুৎপাতের আশঙ্কা নেই বলেই জানিয়েছেন তিনি।

তাফতানকে এতদিন পর্যন্ত ৭ লক্ষ বছরেরও আগে শেষ অগ্ন্যুৎপাত ঘটানো এক ‘নিষ্ক্রিয়’ আগ্নেয়গিরি হিসেবে মনে করা হত। কিন্তু ২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকে ক্রেটার এলাকা থেকে ধোঁয়া ও তীব্র সালফারের গন্ধ বেরোতে শুরু করে, যা ৫০ কিলোমিটার দূরের খাশ শহর পর্যন্ত পৌঁছয়। গবেষকেরা পুনরায় স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হন—ভূমির পৃষ্ঠে বিকৃতি ঘটছে। চূড়ার ফিউমারোল বা গ্যাস নির্গমনের ছিদ্রগুলি দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ টন সালফার ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে—যা ভূগর্ভস্থ চাপে বৃদ্ধির ইঙ্গিত। মে ২০২৪-এ দু’বার প্রবল গ্যাস নির্গমনের ঘটনাও সেই সংকেতকে আরও জোরদার করেছে।

বিজ্ঞানীরা নতুন ‘কমন মোড ফিল্টার’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বায়ুমণ্ডলের গোলমাল সরিয়ে সূক্ষ্ম ভূমির নড়াচড়া সনাক্ত করতে পেরেছেন। এতে দেখা গিয়েছে, তাফতানের চূড়ার নিচের মাটি ধীরে ধীরে ফুলে উঠছে, এবং ঢালগুলি সামান্য বাইরের দিকে সরে যাচ্ছে—যা ভূগর্ভে গ্যাস বা গরম তরল জমে থাকার লক্ষণ। সাধারণত এমন উত্থান কয়েক সপ্তাহেই থেমে যায়, কিন্তু এবার তা দীর্ঘস্থায়ী, যা ক্রমাগত চাপ বৃদ্ধির ইঙ্গিত বহন করছে।

তাফতান ইরান ও পাকিস্তানের সীমানা অঞ্চলের মাকরান সাবডাকশন জোনে অবস্থিত, যেখানে আরবীয় টেকটোনিক প্লেট ইউরেশীয় প্লেটের নিচে সরে যাচ্ছে। এই ভূ-সংঘর্ষই সেখানে আগ্নেয়গিরি ও ভূমিকম্পের প্রধান কারণ। বিজ্ঞানীদের মতে, তাফতানের এই জেগে ওঠা পুরো মাকরান আগ্নেয়গিরি বলয়ের নতুন মূল্যায়নের দাবি রাখে, কারণ আশেপাশের আরও আগ্নেয়গিরি হয়তো নিঃশব্দে সক্রিয় হয়ে উঠছে।

তবে তাফতানে কোনও স্থলভিত্তিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র নেই। দুর্গম অঞ্চল ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে সেখানে সরেজমিনে গবেষণা প্রায় অসম্ভব। তাই উপগ্রহচিত্রই বিজ্ঞানীদের প্রধান ভরসা। গনসালেস বলেছেন, ‘‘এই গবেষণার উদ্দেশ্য আতঙ্ক ছড়ানো নয়, বরং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করা যে, এই অঞ্চলে নজরদারি ব্যবস্থায় বিনিয়োগ জরুরি।’’

যদিও বর্তমানে তাফতান থেকে সরাসরি বিপদের আশঙ্কা নেই, তবু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—যদি এই চাপ ক্রমশ বাড়ে, ভবিষ্যতে ছোটখাটো বাষ্প-ভিত্তিক বিস্ফোরণ বা বড় অগ্ন্যুৎপাত ঘটতে পারে। সেই ক্ষেত্রে ইরানের খাশ শহর বা পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী তাফতান শহরের বাতাস ও জল দূষিত হতে পারে, ফসল ও ঘরবাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন