মা দুর্গার আরাধনা আসলে প্রকৃতিপূজা

নবপত্রিকার জন্য নির্বাচিত প্রতিটি গাছই সমগ্র মানবজাতির পক্ষে অপরিহার্য। সুরঞ্জন

নবপত্রিকার জন্য নির্বাচিত প্রতিটি গাছই সমগ্র মানবজাতির পক্ষে অপরিহার্য।

শ্রীশ্রী চণ্ডীতে বর্ণিত উপাখ্যান অনুযায়ী, ‘সুরথ (রাজা) ও সমাধি (বৈশ্যপুত্র) নদীতীরে দুর্গাদেবীর মাটির প্রতিমা তৈরি করে ফুল-ফল, ধূপ-দীপ ও নৈবেদ্য উপাচারে দেবীর পূজা করেন। তাঁরা কখনও না খেয়ে কখনও বা অল্পাহারী থেকে এবং সমাহিত হয়ে তদগতচিত্তে স্বদেহ রক্ত-সিক্ত (পশুকুষ্মাণ্ডাদি) বলি দেবীর চরণে নিবেদন করেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী, সুরথ ও সমাধি নদীতীরে মেধসমুণির আশ্রমে পুজো সমাপ্ত করে দেবীপ্রতিমা নদীতে বিসর্জন করেছিলেন।

সে পুজো হয়েছিল চৈত্রমাসে। যখন সূর্য উত্তরায়নে থাকে। অর্থাৎ চৈত্রের শুক্লা সপ্তমী থেকে দশমী তিথিতে। যাকে এখনও আমরা বাসন্তী পুজো হিসাবে জানি। কিন্তু বাংলায় তথা সারা ভারতে যে পুজো সবচেয়ে জনপ্রিয় তা হল শারদীয় দুর্গাপুজো।শরৎকালে হল বলেই শারদীয়। প্রবাসী বাঙালি তথা ভারতীয়রাও শারদীয় দুর্গাপুজোকেই উৎসবের মতো পালন করে থাকেন। এই সময় সূর্য অবস্থান করে দক্ষিণায়নে। পুরান মতে যখন দেবতারা নিদ্রিত থাকেন। লঙ্কারাজ রাবনের ডেরা থেকে বন্দি সীতাকে উদ্ধারের জন্য যুদ্ধে দেবীর অনুগ্রহ লাভে এ সময়ে পুজো করেছিলেন রামচন্দ্র। সেটাও শরৎকালে। তাই একে অকাল বোধন বলা হয়। এই বোধন আচারটি করা হয় বেলগাছের তলায়, কারণ বেলগাছকে বলা হয় শ্রীবৃক্ষ। ষষ্টীতিথির সায়ংকালে করণীয় পুজো শেষ করে বেলগাছের মূলে গিয়ে পুজো করার রীতি আছে। উদ্দেশ্য দেবতাদের নিদ্রার সময় দেবীকে জাগরন।

পরদিন, মহাসপ্তমীর সকালে নবপত্রিকা স্নান করিয়ে এনে মণ্ডপ দ্বারে তাঁর পুজো হয়। সেই নবপত্রিকায় থাকে নয়টি বিভিন্ন গাছ যার মধ্যে পাঁচটি ওষধি অর্থাৎ একবার ফল দিয়েই যে গাছ মরে যায় আর চারটি স্থায়ী গাছ। প্রত্যেকটি গাছই কোনও না কোনও দেব বা দেবীর প্রতীক হিসাবে একত্রিত করে নবপত্রিকা তৈরি হয়। ‘রম্ভা কচ্চী হরিদ্রা চ জয়ন্তী বিল্বদাড়িমৌ। অশোকা, মানকশ্বৈব ধান্যাঞ্চ নবপত্রিকা।।’ অর্থাৎ গাছগুলো হল রম্ভা বা কলা, কালকচু, হরিদ্রা বা হলুদ, জয়ন্তী, বিল্ব বা বেল, দাড়িম বা ডালিম, অশোক, মানকচু এবং ধান। এই নবপত্রিকাকে নদী, দীঘিতে স্নান করিয়ে মণ্ডপে নিয়ে এসে মণ্ডপ দ্বারে পুজো সেরে শাড়ি পরিয়ে, সাজিয়ে দেবী প্রতিমার ডানদিকে গণেশের পাশে স্থাপন করা হয়। যাঁকে সচরাচর কলাবৌ বলা হয়ে থাকে। দশমী পর্যন্ত চারদিনই দেবীর প্রতীক হিসাবে পুজো করা হয়। বলা ভাল, দেবীর অন্য একটি রূপ এই নবপত্রিকা।

বেলের অধিষ্ঠাত্রী মহাদেব, কলাগাছ রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচুগাছ কালিকার প্রতীক, হলুদ বা হরিদ্রাতে দুর্গা, ধান লক্ষ্মীর, জয়ন্তী-কার্তিক, ডালিম বা দাড়িম্বগাছ-রক্তদণ্ডিকা, মানকচু চামুণ্ডার আর অশোক দেবী শোকরহিতার প্রতীক। প্রত্যেক দেব বা দেবীকে আবাহন করে নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে পুজো করার রীতি। সব গাছকে বিভিন্ন দেব-দেবীর নামে পুজো শেষে নবপত্রিকায় দুর্গার আবাহন করা অর্থাৎ, প্রচলিত কাহিনির কলাবউ কখনওই গণেশের বউ নয়।

এ কথা অনস্বীকার্য যে নবপত্রিকার জন্য নির্বাচিত প্রতিটি গাছই সমগ্র মানবজাতির পক্ষে অপরিহার্য। এছাড়া পঞ্চপল্লব, আম, অশোক, বট, অশ্বত্থ, যজ্ঞডুমুর- এইসব গাছের একটি করে পল্লব নিয়ে পঞ্চপল্লব তৈরি করে ঘটে স্থাপন করা হয়। সঙ্গে থাকে সশীষ ডাব। এছাড়া অর্ঘ্যের জন্য দরকার দুর্বা, যজ্ঞের জন্য অশ্বত্থ পাতা আর আহুতি দেওয়া হয় বেলপাতা। সঙ্গে থাকে ফুলমালা, ফলমূলাদি। তাহলে দেখা যাচ্ছে সমগ্র প্রকৃতিকে একত্রে জড়ো করে পুজো উপকরণ সাজানো হয়। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই মহাপুজোর সময় নির্বাচন হয়েছে বছরের এমন একটা সময়, যখন বর্ষা শেষ কিন্তু শীত আসতে কিছুটা বাকি। মাঠে কৃষির প্রাথমিক কাজ শেষ, ধানের শীষ দেখা গিয়েছে। এবার ধান পাকলে ধান কাটা হবে। এর মধ্যে এই অবসর সময়ে কৃষিজীবি সকলেই আশান্বিত মনে উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারেন। অর্থাৎ ঋতুবৈচিত্রে সমৃদ্ধ প্রকৃতির সমস্ত সুযোগ নিয়ে এ পুজো বা উৎসবের আয়োজন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন